ভূমিকাঃ কৈবর্ত্য বিদ্রোহে দ্বিতীয় মহীপাল রাজ্য ও প্রাণ দুটোই হারিয়েছিলেন, তাঁর দুই ভাই শূরপাল ও রামপাল মগধে আশ্রয় নেন। শূরপাল সম্ভবত মগধে খুবই অল্পোকাল রাজত্ব করেন এবং এরপর রামপাল রাজা হন। রামপাল সিংহাসনে আরোহনের পর স্বীয় শক্তি ও সামন্তরাজাদের সহায়তায় পিতৃভূমি বরেন্দ্র উদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনিই পাল বংশের শেষ ও শ্রেষ্ঠ রাজা। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা স্থায়ী হয়নি। তিনিই পাল বংশের শেষ শ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি পালবংশের অনিবার্য পতনকে কিছুটা বিলম্বিত করেন মাত্র, নিচে যাওয়ার আগে প্রদীপ যেমন উজ্জ¦ল হয়ে উঠে, রামপালের রাজত্বকালে পালরাজ্যের কীর্তি শিখাও তেমনি শেষবারের মত জ্বলে উঠেছিল।
উৎসঃ যে সকল উৎস হতে রামপালের রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায় তা নিম্নোক্ত –
১। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’।
২। অনন্তবর্মার লিপি।
৩। মনহলি তাম্রলিপি।
৪। বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসন।
৫। ভূমিপট্টলী।
পরিচয় ও সিংহাসনারোহনঃ রামপাল রাজা তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র এবং দ্বিতীয় শূরপাল ও দ্বিতীয় মহীপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। কৈতর্ব্য শূরপাল ও দ্বিতীয় মহীপালের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপাল রিরুপে কারাগার হতে মুক্তিলাভ করেন। তা জানা যায় না। বরেন্দ্র হতে পালিয়ে কোন এক অংশে, সম্ভবত সগধে, শূরপাল রাজসিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর রাজত্বকালের কোন বিবরণই জানা যায় না। সম্ভবত তিনি খুব অল্পকাল (১০৮০ – ১০৮২ খৃষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন। এরপর রামপাল সিংহাসনে বসেন এবং আ. ১১৩০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
বরেন্দ্র পুনরুদ্বারঃ রামপাল রাজ্যভার গ্রহণ করেই বরেন্দ্র উদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি দিব্য ও তাঁর বংশধরের হাত থেকে বরেন্দ্র পুনরুদ্বারের কাজে হাত দেন। সম্ভবত দিব্য মগধ থেকে পাল অধিকার লুপ্ত করার জন্যে চেষ্টা করেন। এই সূত্রে রামপালের সঙ্গে দিব্যের তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। দিব্যের মৃত্যু হলে তাঁর ভাই রুদ্দোক বা রুদ্র এবং তাঁর পুত্র ভীম বরেন্দ্রীর সিংহাসনে বসেন। রামপাল বরেন্দ্রীর সামন্ত রাজাদের সাহায্যে চাইলে তাঁরা ভীমের প্রতি আনুগত্য দেখান এবং রামপালকে প্রত্যাখান করেন। শেষ পর্যন্ত রামপাল তাঁদের ভূমি ও অর্থদানের প্রলোভন দেখালে তারা রামপালকে সাহায্যে করতে রাজী হন।
সাহায্যকারী সামন্তরাজাঃ রামপাল পিতৃভূমি বরেন্দ্র উদ্ধারে যেসকল সামন্ত রাজার সাহায্য পান তাঁদের নাম নীচে দেয়া হলঃ-
১। সগধ ও পীঠির অধিপতি ভীমযশ।
২। কোটাটবীর রাজা বীরগুণ।
৩। দন্ডভুক্তির রাজা জয়সিংহ।
৪। দেবগ্রামের রাজা বিক্রমরাজ।
৫। অরণ্য প্রদেশস্থ অপরমন্দারের লক্ষীশূর।
৬। কুঞ্জরবটির শূরপাল।
৭। তৈলকম্পের রুদ্রশিখর।
৮। উচ্ছালের ভাস্কর ময়গলসিংহ।
৯। তেক্করীরাজ প্রতাপসিংহ।
১০। কয়ঙ্গল মন্ডলের নরসিংহার্জুন।
১১। সংকটগ্রামের চন্ডর্জুন।
১২। নিদ্রাবলির রাজা বিজয়রাজ।
১৩। কৌশাম্বীর দ্বোরপবধন।
১৪। পদুবম্বার রাজা সোম।
বরেন্দ্র অভিযানঃ এই সমন্ত রাজা ছাড়াও রামপালের প্রধান সহায়ক ছিলেন মাতুল রাষ্ট্রকৃটকুলতিলক মথন বা মহন। তিনি তাঁর দুই পুত্র কাহ্নরদেব ও সুবর্ণদেব এবং ভ্রাতুষ্পুত্র শিবরাজকে সঙ্গে নিয়ে রামপালকে সাহায্যে করতে এসেছিলেন। রামপাল প্রথমে শিবরাজের অধীনে এক অগ্রগামী সৈন্যাদল বরেন্দ্র অভিযানে পাঠান। এই সৈন্যদল গঙ্গানদী পার হয়ে বরেন্দ্রভূমি বিধ্বস্ত করে ফিরে আসে। রামপালের নেতৃত্বে মূল সৈন্যদল গঙ্গা অতিক্রম করলে ভীমের সঙ্গে এক তুমুল যুদ্ধের সূচনা হয়। রামপাল দক্ষিণ পশ্চিম বাংলা থেকে গঙ্গা অতিক্রম করে বরেন্দ্র আক্রমণ করেছিলেন।
ভীমের পরাজয়ঃ যুদ্ধে রামপাল ও ভীম উভয়ই বিশেষ বিক্রম প্রদর্শন করেন। রামপালের আক্রমণে ভীম পরাস্ত ও বন্দী হন। ভীমকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বারেন্দ্রীর অধিকার পুনরায় পাল বংশের হাতে আসে। রামপালের বাহিনী ভীমের সীমান্ত ঘাঁটি অধিকার করলে, ভীম রামপালের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য তাঁর সেনাদল পাঠান। তাঁর সেনাপতি হরির বিশ্বাসঘাতকতায় ভীমের পতন ঘটে। বরেন্দ্রী রামপালের অধীনে চলে আসে।
পালশাসনঃ
পুনঃ প্রতিষ্ঠাঃ বহুদিন কৈবর্ত্যশাসনে থাকার পর রামপাল বরেন্দ্রে পালশাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। কৃষির উন্নতি ও প্রজার করভার লাঘব প্রভৃতি পুনর্বাসনমূলক কাজে তিনি রামাবতী নামক এক নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী পালরাজাদের শাসনকালে রামাবতীই সা¤্রাজ্যের রাজধানী ছিল। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী এই নগরীর রূপ ও বৈভরের উচ্ছসিত প্রশংসা করেন।
রাজ্যবিস্তারঃ পিতৃভূমি বরেন্দ্র পুনরাধিকার করে রামপাল নিকটবর্তী রাজ্যসমূহে প্রভাব বিস্তার করে পাল সা¤্রাজ্যের লুপ্ত গৌরব উদ্ধার করতে সচেষ্টা হন। রামচরিতে বলা হয়েছে যে, পূর্ব অঞ্চলের বর্মন রাজা ছিলেন সম্ভবতঃ পূর্ব বাংলার বিক্রমপুরের হরি বর্মন। রামপালকে বশ্যতা দেন। এই বর্মন রাজা ছিলেন সম্ভবতঃ পূর্ব বাংলার বিক্রমপুরের হরি বর্মন। রামপাল কামরূপ রাজা ধর্মপালকে বাধ্য করেন। পূর্বে এভাবে সীমান্ত দৃঢ় করে দক্ষিণে দৃষ্টি দেন। রাত দেশের সামন্তরা তাঁর প্রতি বশ্যতা স্বীকার করলে, রামপাল রাঢ় দেশ হয়ে, দক্ষিণে উৎকল এই আত্মবির্সজনের দৃষ্টান্ত জগতে বিরল। একখানি পুথিঁর পুষ্পিকা হতে জানা যায় যে, রামপাল অন্তত ৫৩ বৎসর রাজত্ব করেন।
কৃতিত্বঃ রামপাল কৈবর্ত্য রাজাদের হাত থেকে পৈত্রিক সিংহাসন উদ্ধার করে এবং প্রতিবেশী রাজাদের পরাস্ত করে তাঁর যোগ্যতা ও শক্তি দেখান। রামপাল কর্ণাটের লোলুপ দৃষ্টি হতে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলেন। এটা তাঁর বিরাট কৃতিত্ব। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তিনি মধ্যপ্রদেশের রাজ্যবিস্তার প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন।
মৃত্যুঃ বৃদ্ধবয়সে রামপাল মাতুল মহণের মৃত্যুসংবাদ শুনে শোকাকুল হয়ে গঙ্গা গর্ভে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন। বন্ধুর শোকে বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করে ছিলেন। তাঁর বাহুবলে খন্ডবিখন্ড বাংলাদেশে আবার একতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখল। নিভে যাওয়ার ঠিক আগে প্রদীপ যেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠে। রামপালের রাজত্বকালে পাল রাজ্যের কীর্তি শিখাও তেমনি শেষবারের মতো জ্বলে উঠল, রামপালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পালবংশের গৌরববরি চিরদিনের জন্য অস্তমিত হয়।
উপসংহারঃ রামপালের জীবন ও মৃত্যু উভয়ই বিচিত্র। তাঁর জীবন কাহিনী ইতিহাস অপেক্ষা উপন্যাসরই অধিক উপযোগী, কারাগারে বন্দী অসহায় রামপাল কিরূপে জীবন রক্ষা করেছিলেন ইতিহাসে তার সন্ধানে রাখে না। ধর্মপাল ও দেবপালের উত্তরাধিকারী এবং প্রথম মহীপালের বংশধর ভারতপ্রসিদ্ধ রাজবংশের এই শেষমুকুটমণি লজ্জা ঘৃণা ত্যাগ করে অধীনস্থ সামন্তরাজগণের দ্বারে দ্বারে সাহায্যে আশায় ঘুরতে লাগলেন। তাঁর উদ্যম ও অধ্যবসায়ে বরেন্দ্র পুনরাধিকৃত হল। বাংলাদেশ সর্বত্র তিনি প্রভুত্ব বিস্তার করলেন এবং বাংলাদেশের সর্বত্র তিনি প্রভুত্ব বিস্তার করলেন এবং কামরূপ ও উৎকল জয় করলেন। দক্ষিণে দিগি¦জয়ী অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গ এবং পশ্চিমে চালুক্য ও গাহড়বাল এই তিনটি প্রবল রাজশক্তিরআক্রমণ করেন। রামচরিত অনুসারে রামপাল উৎকল জয় করে কলিঙ্গাদেশ পর্যন্ত স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্টা করেন। অনন্তবর্মার লিপি হতে জানা যায়। ১১৩৫ আব্দের পূর্বে তিনি উড়িষ্যা হতে জানা যায়। ১১৩৫ অব্দের পূর্বে তিনি উড়িষ্যা জয় করে স্বীয় রাজ্যভুক্ত করেন।