লেখকঃ আবুল মাল আব্দুল মুহিত (প্রয়াত সাবেক অর্থ মন্ত্রী)
অধুনা দেশকে নিয়ে আমরা অনেক গর্ববোধ করি। গর্ববোধ করার বিশেষ কারণও রয়েছে। সেটা হচ্ছে স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ থেকে আমরা দারিদ্র্যকে অতি দ্রুত বিতাড়ন করেছি ও করছি। অথচ একসময় দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। বর্তমানে এই হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশে অবনমিত হয়েছে।
একই সঙ্গে দেশে ব্যাপক হারে অতিদারিদ্র্যের সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে অতিদারিদ্র্যের হার এক অঙ্কের মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ এখন বেশ অগ্রসর। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সব পরীক্ষা শেষ হলে ২০২১ সালেই মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ।
কিন্তু এই গর্ববোধ খুবই খর্ব হয়ে যায় যখন দেখি আমাদের দুটি সূচক অত্যন্ত নিকৃষ্ট। আমাদের দেশে এখনো গভীরভাবে পুষ্টির অভাব রয়েছে এবং এই অভাবটা সবচেয়ে বেশি শিশুদের ক্ষেত্রে। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই দেশের শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। পুষ্টিহীনতা কমানোর জন্য অনেক সমন্বিত পদক্ষেপের দরকার। যেমন সন্তান যখন মায়ের গর্ভে থাকে, মাকে তখন যথোপযুক্ত খাবার দিতে হয়। জন্মের পরপর বাচ্চাকেও দিতে হয় উপযুক্ত খাবার।
আমি মনে করি, শুধু বাজেট বরাদ্দই যথেষ্ট নয়। খুব ভালো করেই জানি, যেকোনো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। পুষ্টিহীনতা দূর করতে আমাদের খুব সাবধানে নানা পদক্ষেপ নিতে হবে, যতটুকু সম্ভব নিচ্ছিও আমরা। তবে যে বিষয়টা নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত, সেটা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ আমরা অনেক কমিয়েছি। অন্তত ১৪ বছরের নিচে এখন সচরাচর কোনো মেয়ের বিয়ে হয় না। কিন্তু ১৮ বছরের নিচের মেয়েদের বিয়ে হয় প্রচুর। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হওয়াটা একান্তই অনুচিত। অনেক মেয়ে ১৮ বছরের মধ্যে সন্তানও ধারণ করে। মা-সন্তান দুজনের জন্যই এটা ক্ষতিকারক।
আমাদের দেশে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে অনেক ক্ষেত্রে ১৮ বছর লেগে যায়। তাই ১৮ বছরের আগে যাদের বিয়ে হয়, তাদের অনেকেই শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে যায়। অথচ আমাদের মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ায় অনেক আগ্রহ লক্ষ করি।
আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে তাদের সংখ্যা কমে যায় এবং মাধ্যমিকের পরের পর্যায়ে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে। ৭০ শতাংশ যে লেখাপড়া থেকে বাদ পড়ে যায়, তা আমাদের জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমি বলব বস্তুত তা লজ্জাজনক।
তাই আমি যখনই সুযোগ পাই, তখনই উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানাই, দুটি ব্যর্থতা আমাদের অতিক্রম করতেই হবে। সমাজ থেকে অপুষ্টি যেমন দূর করতে হবে, পরিহার করতে হবে বাল্যবিবাহকেও। মায়ের পেটে থাকার সময় থেকেই শিশুর পুষ্টির প্রতি নজর রাখতে হবে। আর এই অঙ্গীকারও আমাদের করতে হবে যে অন্তত ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েকে আমরা বিয়ে দেব না।