১৭৮৯ সালে ইংরেজ কবি উইলিয়ম ব্লেক ‘দা স্কুল বয়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। স্কুল পড়ুয়া বালকটি স্কুলের দমবন্ধ পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠেছে। শিক্ষকদের কঠোর এবং আনন্দহীন শিক্ষাদানে সে অসুখী বোধ করেছে। বরং সে স্কুলের বাইরে গ্রীষ্মকালীন সকালে প্রতিটি গাছে পাখির গান উপভোগ করতে চেয়েছে। সে তার বাবা-মাকে স্কুলের ওই গোলামি থেকে উদ্ধার করতে মিনতি জানিয়েছে। ২০২১ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজও আমরা ব্লেকের কবিতায় উল্লেখিত সেই বালকটির করুণ মিনতির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। বালকটি মূলত আমাদের শিশুদের প্রতীকী রূপ। শিক্ষা লাভ করা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার এবং এই শিক্ষা অবশ্যই আনন্দের ভেতর দিয়ে হতে হবে। আর সেই আনন্দের অন্তর্তলে থাকবে আকর্ষণও। শিক্ষার্থীর মনে স্বপ্ন জাগিয়ে দিতে হবে যে স্বপ্ন সে ঘুমিয়ে দেখবে না। বাস্তবে সেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা লাভের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শুরু হয় ক্লাস ওয়ান অথবা স্টান্ডার্ড ওয়ান থেকে। এই ক্লাসে ভর্তির আগেই শিশুদের পড়াশোনা করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যেতে হয়। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯-এর শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘শিশুরা প্রথমে স্কুলে যাবে এবং হাসি-খেলার মধ্যে দিয়েই লেখাপড়া করবে। তারা তো আগে থেকেই পড়ে আসবে না। পড়ালেখা শিখতেই-তো সে স্কুলে যাবে’।
প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল বটে তবে সেখানে পরীক্ষা ভীতি ছিল না। ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর শিশুদের রূপকথাময় শৈশবকে পুরোপুরি গলা টিপে হত্যা করা হলো। মূল বইয়ের পাশাপাশি তাদের পড়ার টেবিলে গাইড বইয়ের সমারোহ দেখা গেল। মায়েরা সন্তানদের নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। দশ বছরের একটি শিশু বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে- এ বিষয়টি পরিবার ও শিশুর জন্য কতটা চাপ সৃষ্টি করছে- তা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কেউ-ই বিবেচনায় নিলেন না। শুধু ক্লাস ফাইভে নয় ক্লাস এইটেও ২০১০ সাল থেকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা নেওয়া শুরু হলো। ফলে শিশুরা পরীক্ষা ভীতির ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠল। নির্ভার এবং আনন্দময় একটি শৈশব কাটানো যে শিশুর জন্মগত অধিকার তা দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া হয়েছে।
কোনো কিছুই আর শিশুর জীবনে তার হারিয়ে যাওয়া শৈশব ফিরিয়ে দেবে না। মুখস্থ নির্ভর লেখাপড়ার ইতি টানার লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে মাধ্যমিকে এবং ২০১২ সাল থেকে প্রাথমিকে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বলা হয়েছিল এই পদ্ধতির অনুশীলনে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান এবং দক্ষতায় অনেক দূর এগিয়ে যাবে। বাস্তবে দেখা গেছে তেমন কিছু ঘটেনি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা এই পদ্ধতি ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি। তবে পুস্তক ব্যবসায়ীরা খুব ভালো ব্যবসা করেছেন। কোচিং সেন্টারও ছিল রমরমা।
এ সব নানা দোলাচলের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে এবং তা বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। নতুন এই শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া হবে আনন্দময় পরিবেশে। মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনা সেখানে থাকছে না।
বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের চাপ ও বোঝা কমানোর কথা বলা হয়েছে। সনদের জন্য নয় বরং জ্ঞান এবং দক্ষতায় পারদর্শী হতে শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত হতে বলা হয়েছে। পরীক্ষার চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। এসব শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হবে শিখন কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মূল্যায়নের পাশাপাশি পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী সময় এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় দশ ধরনের শেখার ক্ষেত্র নির্বাচন করা হয়েছে। বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ভাষা ও যোগাযোগ, জীবন ও জীবিকা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ভাষা। এই ভাষাগত দক্ষতা আমাদের শিক্ষার্থীরা কতটা অর্জন করছে সেটি নিয়ে অনেক কথা নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করে যখন তারা চাকরির জন্য আবেদন করে তখনই বোঝা যায় তাদের ভাষাগত পারদর্শিতা কতটা! আবার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে পড়ার পরেও ইংরেজি লেখা এবং বলার দক্ষতা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অর্জন করতে পারে না। এ কারণেই ভাষা ও যোগযোগ বিষয়টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ১০টি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: জীবন ও জীবিকা। হার্বাট স্পেনসারের মতে, ‘শিক্ষার কাজ হল মানুষকে জীবন ও জীবিকার উপযোগী করে তোলা’। মানুষকে জীবিকার উপযোগী করে তোলা অনেকটাই সহজ বলে মনে হয়, তবে জীবনের উপযোগী করে তোলা খুব সহজ কাজ নয়।
জীবন কী? জীবনের সঙ্গে পৃথিবীর সবকিছুই জড়িয়ে রয়েছে। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে জীবন ঘনিষ্ঠ সকল কিছুর সঙ্গে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্ত করে দেওয়া যেন সে আদর্শ নাগরিক হতে পারে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল-কথাটি আমরা শিশুকাল থেকেই শুনছি। অথচ কে না জানে আমাদের দেশে নানা অছিলায় শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে অবহেলিত। মানসিক স্বাস্থ্যের কথা আমাদের মতো দেশে বলতে গেলে ভাবাই হয় না। যে কোনো কাজের পূর্বশর্ত সুস্থ থাকা। শিক্ষার্থীরা যদি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে তবে তারা লেখাপড়া শিখবে কীভাবে? বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার্থীরা নিশ্চয় পরিবার, বিদ্যালয় এবং খেলার মাঠের পরিবেশ এবং শিক্ষকের কাছ থেকেই শিখবে। শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন না করলে শিক্ষার্থীরা ভাষা, জাতি, দেশ এবং বিশ্বকে পুরোপুরি নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারবে না।
পরিবারের বাইরে শিক্ষার্থী প্রথম সমাজীকরণের মুখোমুখি হয় বিদ্যালয়ে। শিক্ষকের ভূমিকাই সেখানে মুখ্য। শিক্ষককে হতে হবে দয়ালু, যত্নবান ও শিক্ষার্থী-বান্ধব। সর্বোপরি অপরিসীম ভালোবাসা নিশ্চিতভাবেই শিক্ষকের থাকতে হবে শিক্ষার্থীর প্রতি। শিক্ষক যে বিষয়ে পড়াবেন সে বিষয়ে অবশ্যই তার পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকের নিজের জীবন হতে হবে নির্ভার ও আনন্দপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে মেধাবী এবং তরুণদের শিক্ষকতা পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। এ বিষয়ে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নকে পরীক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে-এটি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। সহশিক্ষা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করবে-এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে এই শিক্ষাক্রম যে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতা নিয়ে। সহশিক্ষা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নে স্বচ্ছতা এবং বিশ্বস্ততার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে সরকারকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আস্থা এবং বস্তুনিষ্ঠার জায়গাটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। সহশিক্ষা কার্যক্রমের যে বিষয়েই শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়া চলুক না কেন তা সম্পন্ন হতে হবে আনন্দের ভেতর দিয়ে। সহশিক্ষা কার্যক্রম একজন শিক্ষার্থীকে কৌতূহলী, সৃজনশীল এবং তার বুদ্ধিমত্তার সঠিক বিকাশ ঘটাতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও সরকার ঘোষিত নতুন শিক্ষাক্রমকে মহৎ উদ্যোগ বলতেই হয়। তবে এই শিক্ষাক্রমকে সফলতার দরজায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ প্রয়োজন তা কী সরকারের নাগালের মধ্যে রয়েছে? পাঠ্যবই তৈরি করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা-সেটি যথাযথ উদ্যোগ। তবে এত কম সময়ে কী মানসম্পন্ন, যুগোপযোগী এবং শিক্ষার্থীবান্ধব পাঠ্যবই রচনা করা সম্ভব? বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অন্যটি হচ্ছে-শিক্ষক। মানসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া কোনোভাবেই এই শিক্ষাক্রম ফলপ্রসূ হবে না। আসলে পুরো বিষয়টিই চ্যালেঞ্জিং।
সৈয়দা আইরিন জামান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সুত্রঃ প্রথম আলো