টাকাভর্তি ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিল মম মল্লিক। তারপর পুলিশের সহযোগিতায় ফিরিয়ে দিয়েছে প্রকৃত মালিকের কাছে। নবম শ্রেণিপড়ুয়া মমর এই সততার কাহিনি এখন এলাকার সবার জানা।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাটবাটী গ্রামে ঢুকেই
দেখা যায় সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকজন মানুষ গল্প করছেন। তাঁদের কাছে জানতে
চাওয়া হয় মম মল্লিকের বাড়ির ঠিকানা। এর মধ্যে একজন বলে ওঠেন, ‘যে দুই লাখ
টাকা পেয়ে ফেরত দিয়েছে সেই মম?’ সম্মতিসূচক বাক্যের পর তাঁরা দেখিয়ে
দেন—কোথায়, কীভাবে মমদের বাড়িতে যেতে হবে।
ওই এলাকার এখন প্রায়
সবাই চেনে মম মল্লিককে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ওই মেয়েটিই এখন ঘুরেফিরে
এলাকার মানুষের আলোচনার বিষয়। কয়েক দিন আগে ব্যাগভর্তি টাকা পেয়েও তা
মালিককে ফেরত দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে সে। ঘটনাটি শুধু গ্রাম
নয়, ছড়িয়ে গেছে আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও।
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট মম মল্লিক। হোগলবুনিয়া-হাটবাটী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে বাণিজ্য শাখায়। বাবা শংকর কুমার মল্লিক একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য। কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাগভর্তি টাকা ফেরত দেওয়ার পর ব্যাপক প্রশংসায় ভাসছে মম।
ঘটনাটি ৯ সেপ্টেম্বর সকালের। খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছিল দিনটি। অন্য দিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার তাড়া শুরু হয়। পৌনে আটটার মধ্যে যেতে হবে কয়েক মাইল দূরের সেই শিক্ষকের বাড়িতে। এ কারণে তাড়াও বেশি।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই ভ্যানে ওঠে মম। ভ্যানচালক ছিলেন বয়স্ক একজন। বাড়ির সামনে থেকে ভ্যানে ওঠার সময় ছিল দুজন। বটিয়াঘাটা বাজারেই নেমে যায় অন্যরা। বাজার পার হয়ে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে একটি ছোট খয়েরি রঙের ব্যাগ পড়ে আছে। ব্যাগটি পড়ে থাকতে দেখেই সন্দেহ হয়। সেই সন্দেহ থেকেই ভ্যানচালককে দাঁড় করায় সে। ব্যাগটি কুড়িয়ে চেইন খুলে দেখে তাতে অনেক টাকা। রয়েছে কিছু কাগজপত্রও। সাতপাঁচ না ভেবে ব্যাগটি নিয়ে ভ্যানে ওঠে। কিছুদূর পরই বটিয়াঘাটা থানা। ব্যাগটি নিয়ে থানার মধ্যে ঢোকে। এ সময় সেখানে গিয়ে দেখে যাঁদের ব্যাগ হারিয়েছে, তাঁরা দুজন সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ব্যাগ হারানোর ব্যাপারে কথা বলছেন। এ সময় তাঁদের সামনে ওই ব্যাগ তুলে ধরা হলে তাঁরাই জানান ওই ব্যাগে দুই লাখ টাকা রয়েছে। জমি কিনতে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তাড়াহুড়ায় দুটি ব্যাগের একটি পড়ে যায়। ব্যাগের মধ্যে থাকা কাগজপত্রের প্রমাণ দিয়ে ওই ব্যক্তিরা ব্যাগটি নিয়ে চলে যান। যাওয়ার সময় জোর করে কিছু টাকা বকশিশ দিয়ে যান মমকে।
মমর বাবা পুলিশ সদস্য হওয়ায় বাবার কাছে বিভিন্ন সময় শুনেছেন নিরাপদ জায়গা হলো থানা। এ কারণে ব্যাগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থানায় যাওয়ার কথা মাথায় আসে তার। এ ব্যাপারে অভিভাবকসহ কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হতে পারে বা অন্য কোনো বিপদ হতে পারে, সে কথা একবারের জন্যও চিন্তা করেনি মম। এমনকি প্রাইভেট পড়তে গিয়ে সেখানকার কারও সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপও করেনি সে। পরে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে সবকিছু খুলে বলে।
মম মল্লিকের ভাষায়, ‘কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাগটি তার মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া আমার দায়িত্ব ছিল, আমি সেটিই করেছি। এখানে অন্য কিছু ভাবাভাবি বা কারও সঙ্গে আলাপ করার কথা একবারের জন্য চিন্তাও হয়নি।’
প্রথম থেকেই স্কুলের সহপাঠীদের কাছে খুবই প্রিয় মম। জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে সে। সাম্প্রতিক ওই ঘটনা সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে তার মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাণিজ্য শাখায় পড়া মম বড় হয়ে বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। এ ছাড়া চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার স্বপ্নও দেখে সে।
চটপটে ও সরল মনের মমকে নিয়ে গর্ব করেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরা। ঘটনাটি জানার পর ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রধান শিক্ষক। এরপর সেটি দ্রুত আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। মম যে কাজ করেছে তা একটি বিরল দৃষ্টান্ত, বলছিলেন প্রধান শিক্ষক অন্নদা শংকর রায়। স্কুলে প্রতিদিন দুটি শপথ পড়ানো হয়। একটি দেশের শপথ ও অন্যটি সততার শপথ। ওই সততার শপথ থেকেই শিক্ষার্থীরা ভালো কাজে উৎসাহিত হচ্ছে বলে মনে করেন প্রধান শিক্ষক। লোভ নয়, ভালো কাজ করেও যে তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটিই দেখিয়ে দিয়েছে মম।
১৯৭৮ সালের দিকে পুলিশ সদস্য থাকাকালে একবার ব্রিফকেস–ভর্তি টাকা পেয়েছিলেন মমর বাবা শংকর মল্লিক। তখন তিনি কর্মরত ছিলেন ঢাকার সূত্রাপুর থানায়। ব্রিফকেসসহ ওই টাকা জমা দেন থানায়। পরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকার মালিক খোঁজা হয়। সন্ধান পেয়ে থানায় গিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে ব্রিফকেসসহ টাকা নিয়ে যান মালিক। বিভিন্ন সময় বাবার কাছে ওই গল্প শুনেছে মম। তাই বাবার মতো মেয়ের মনেও সততার ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে করছেন মমর বাবা। এমন মেয়ের জন্য গর্ব করেন তিনি।
Comments are closed.