লেখকঃ ডি. হুসাইন
আমাদের সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এক হাজার বছরেরও পুরনো । আর আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন বাংলা সাহিত্য আধুনিক যুগে অবগাহন করেছে বেশ কয়েকে শতাব্দী আগেই । প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত করেছে । মনে করা হয় বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ঘটেছিল ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে । হাজার বছরে বাংলা সাহিত্য অনেক বাঁক পেরিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে । পন্ডিতগণ বাংলা সাহিত্যকে তিনটি যুগে ভাগ করেছেন । যুগ তিনটি হচ্ছে :
১। প্রাচীন যুগ : ৯৫০-১২০০ পর্যন্ত।
২। মধ্যযুগ : ১৩৫০-১৮০০ পর্যন্ত ।
৩। আধুনিক যুগ : ১৮০০ থেকে আজ পর্যন্ত, আরো বহুদিন পর্যন্ত ।
যাহোক, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ব্যবচ্ছেদ আমার আলোচনার মূল বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় হলো– শিশু সাহিত্যে : মুক্তিযুদ্ধ ।
আসুন প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক শিশু
সাহিত্য বলে কি বুঝায় ?
শিশু সাহিত্য বলতে বুঝায় — শিশুদের জন্য রচিত তাদের উপযোগী সাহিত্য ।
বাংলাদেশে ৬-১৮ বছর বা ০-১৮ বছর বয়সী কোন মানব সন্তানকে শিশু বলে অভিহিত করা হয় । তাই ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে যে সাহিত্য রচনা করা হয় তাই শিশু সাহিত্য । শিশুদের জন্য উদ্দীপনীয়, শিক্ষনীয়, মনোরঞ্জক গল্প, উপন্যাস, ছড়া-কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি সবই শিশু সাহিত্যের মধ্যে পড়ে ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের মূলভিত্তি । সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের অংশ হিসেবে তাই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক শিশু সাহিত্যের আলোচনা খুবই গুরুত্ববহ । শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি তাই তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে তাদের ইতিহাস সচেতন করাতে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাকদের বঞ্চনা, অত্যাচারের কথা জানান দিতে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক শিশু সাহিত্যের।
দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিসংগ্রাম আমাদের এনে দিয়েছে স্বাধীনতা । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের সাহিত্যে সর্বাঙ্গীণভাবে ফুটে উঠতে যুদ্ধদিনের গৌরবগাঁথা, আর দুর্দশার কথা । ৭১ এর এর পর সেই সময়কার বাংলাদেশি লেখকদের সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ । এখনো মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখালেখি হচ্ছে । ভবিষতেও চলবে । তবে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে শিশু-কিশোরপাঠ্য তথা শিশুতোষ সাহিত্যের ভান্ডার আশানুরূপ বললে অত্যুক্তিই হবে । তাই আমার এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে আমি আদতে সেই বিষয়টি তুলে ধরে এ জাতীয় সাহিত্য রচনায় জোড় দেওয়ার প্রয়াস পাবো ।
সাহিত্যের প্রাধনতম চারটি শাখা হচ্ছে — গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও প্রবন্ধ ।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক যে সকল গল্প ও উপন্যাস উল্লেখ করার মত সেগুলো হলো–
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, আনিসুল হকের ‘মা’, হুমায়ুন আহমদের ‘অনীল বাগচীর একদিন’, আগুনের পরশমণি, সেলিনা হোসেন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প’, জাহানারা ইমামের ‘বুকের ভিতর আগুন ‘, ঝর্ণা দাস পুরুকায়স্থের ‘একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুচ্ছ’, শিশু একাডেমি প্রকাশিত আনোয়ার সৈয়দ হকের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, শাকিল কালামের ‘গল্পে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, মশিউর রহমানের ‘একাত্তরের ছেলেটি’, এনায়েত রসুলের এক শিশি আলতা ইত্যাদি । তাছাড়া যেসব সাহিত্যিক এ ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছে তারা হলেন ইমদাদুল হক মিলন, জুবাইদা গুলশান আরা, আলী ইমাম, মাসুম বিল্লাহ, রফিকুজ্জামান দাদাভাই, মাহবুবুল হক প্রমুখ ।
শিশু সাহিত্যের অরেকটি শাখা হলো ছড়া-কবিতা । ছড়া আমাদের শিশুসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ছড়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সাহিত্যে জীবনের সূত্রপাত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উঠে এসেছে ছড়া সাহিত্যেও। এক্ষেত্রে অগ্রণী ছড়াকারদের মধ্যে রয়েছেন সুকুমার বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম, লুৎফুর রহমান রিটন প্রমুখ। সুকুমার রায় লিখেছেন —
কেমন করে মুক্ত হলো সোনার বাংলাদেশ
একাত্তরের সেই কাহিনী আর হবে না শেষ।
সাগর পারের দত্যি এসে চাপলো যখন ঘাড়ে
দেশের মানুষ হঠাৎ করে বুঝলো হাড়ে হাড়ে।…
কেউ দেখেনি কেউ ভাবেনি তেমন ভীষণ লড়াই
তাই তো এদেশ মুক্ত করে করছি জয়ের বড়াই।
(শেষ হবে না: সুকুমার বড়ুয়া)
সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ায় ফুটে উঠেছে যুদ্ধের পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ের ক্যানভাস ।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক শিশুতোষ কবিতায় যারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তারা হলেন জসীম উদ্দীন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুক হক, আবু জাফর, আসলাম সানী, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ । যেমন
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার পরপরই কবি জসীম উদ্দীন “দগ্ধগ্রাম” শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। ছড়াটির হলো–
কিসে কী হইল, পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি
সারাগাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান
পিতার সামনে মেয়ের কাটিয়া করিল রক্তস্নান।
খানসেনারা এমন জুলুম আর অত্যাচার চালাতে থাকে দীর্ঘ নয় মাস। আমাদের দামাল ছেলেরাও তাদের উপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে, লড়াই করে, প্রতিশোধ নেয়। এর মধ্যে অনেকেই যুদ্ধ করতে গিয়ে বাড়ি ফেরেনা-
সোনামানিক ভাইরা আমার
সেই কবে কোন সনে
দানোর সাথে করতে লড়াই
গিয়েছিলেন রণে।
রণের শেষে মায়ের কোলে
আর ফেরেননি তারা
সেই দুখে মার দু’চোখ গেলো
অশ্রু বাঁধন হারা।
(সোনামানিক ভাইরা আমার: আখতার হুসেন)
আবু জাফরের ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি’
কবিতায় ফুটে উঠেছে যুদ্ধদিনের আদ্যোপান্ত ।
দেখেছি ৭১, সাড়ে সাতকোটি মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলন,
শুনেছি রেসকোর্সে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষন।
দেখেছি রাজাকার-পাঞ্জাবী মিলে করেছে কতোনা অবিচার,
অসহায় লাখো মা-বোন সেদিন হয়েছে নির্যাতনের শিকার।
( আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি : আবু জাফর)
শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। তার একটি হলো-
পাঞ্জাবিরা চেয়েছিলো
বাংলা ভাষা মুছে দিতে
চেয়েছিল এদেশের সব
গায়ের জোরে লুটে নিতে।
যুদ্ধ এবার মুক্তিযুদ্ধ,
দিকে দিকে মুক্তি সেনা-
মাটি ছুঁয়ে নেয় যে শপথ
জন্মভূমির মান দেবে না।
অাঁধার ছিল ন’মাস জুড়ে
নাচলো শেষে আলোকলতা
রক্ত সাগর সেচে পেলাম
সূর্যোদয়ে স্বাধীনতা।
প্রবন্ধ, নিবন্ধ বা শিশু-কিশোর ইতিহাস ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে । মেজর কামরুল হাসান ভূইয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান’, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, এ কে এম নাসিমুল কামালের ‘শিশু-কিশোর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, আইয়ুব হোসেনের ‘শিশু-কিশোর মুক্তিযোদ্ধা’ ইত্যাদি ।
সাহিত্যের ছোট কাগজ তথা ম্যাগাজিনগুলোতে নবীন-প্রবীর অনেক লেখক অজস্র লেখা লিখেছেন এখনো লিখে যাচ্ছেন অবিরত । অনেক প্রথিতযশা শিশু সাহিত্যকের গল্প, উপন্যাস ও কবিতা এই ধারাটি সমৃদ্ধ করেছে যাদের নাম এই স্বল্প পরিসরের লেখনিতে হয়তো উঠে আসেনি ।
যেহেতু মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মূলভিত্তি এবং শিশুরা আমাদের অনাগত আগামীর কর্ণধার তাই তাদের নিয়ে আরো বেশি লেখা উচিত বলে আমি মনে করি । একমাত আমাদের মহান স্বাধীন সংগ্রামকে উপজীব্য করে আরো শিশুসাহিত্যে রচিত হোক । তবেই আমরা একটি উন্নত প্রজন্ম পেতে পারি, যারা হবে শেকড়সন্ধানী, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা লালনকারী, ঋৃদ্ধ ও পরিশীলিত প্রজন্ম।
লেখক : ডি. হুসাইন, লেখক ও শিশু সংগঠক ।
[email protected]