কিছু দিন আগে একটা কেজি স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম।স্কুল ছুটি হওয়ায় একপাশে দাঁড়ালাম পুঁচকেদের কান্ড উৎসুক হয়ে দেখার জন্য।দেখলাম চার পাঁচজন ছাত্র একত্রে দৌঁড়ে বের হয়ে কাঁধের ব্যাগগুলো তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দিল।কিন্তু একজনের অভিভাবক না আসাতে বেচারা ব্যগটি অনিচ্ছার সত্ত্বেও নিজে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে! তবে সবচেয়ে খারাপ লাগল তখন,যখন দেখলাম ব্যাগের ভরে সে যখন অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেনা,দৌঁড়ে ও বন্ধুদের ছুঁতে পারছেনা।আসলে কেজি স্কুল বলতে বইয়ের পাহাড়।সরকারের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে ও অনেক বই ক্ষুদে ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হয় কেজি স্কুলে।তীব্র অনিচ্ছা থাকার পরও প্রতিদিন বইয়ের এত্তো ভারী ব্যাগগুলো রোবটের মতো ছোট্ট কাঁধে করে টেনে নিয়ে যেতে হয় স্কুলে।হয়তো যাদের বাবা মায়ের গাড়ি ঘোড়া আছে তাদের একটু হলেও রেহাই মেলে।কিন্তু যাদের নাই তারা! শিশুদের কাঁধে ভারী বইয়ের ব্যাগ!এটাও কি শিশু নির্যাতন নয়? শিশুদের সাথে এক প্রকার অন্যায় নয়?
[metaslider id=”2106″]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন,যৌন নির্যাতন,অবহেলা বা অন্য কোনভাবে শোষণ করা ইত্যাদি শিশু নির্যাতন।মোদ্দা কথা যে কাজের ফলে শিশুর কোন ক্ষতি হয় কিংবা শিশুর ক্ষতির আশংকা থাকে,তাকে শিশু নির্যতন বলে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের সংঙ্গা দিতে গিয়ে বলেছেন;শিশুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর ইচ্ছাকৃত শারীরিক জোর কাটানো হলো শারীরিক নির্যাতন।আর জাতিসংঘের সাধারণ স্টাডির মতে সাবান দিয়ে শিশুদের মুখ ধুতে বা ঝাল খাবার খেতে বাধ্য করা ও যদি এক ধরনের শারীরিক নির্যাতন হয়।তাহলে কাঁধে ভারী বইয়ের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়া ও কি শারীরিক নির্যাতনের পর্যায়ে পরে না।বলতে গেলে এক প্রকার আমরা জোর করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোমল কাঁধে বইয়ের ভারী বোঝা চাপিয়ে দিই।যা আমাদের মনের অজান্তে তাদের সাথে ঘোরতর অন্যায়।
ভারী ব্যাগ কাঁধে তুলে দিলেই যে শুধু শারীরিক নির্যাতন হয় তা কিন্তু নয়।এর ফলে শিশুর নানাবিধ শারীরিক ক্ষতি ও হতে পারে।যেমন;ঘাড়ব্যথা,পিটব্যথা ইত্যাদি।বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মতে দীর্ঘদিন ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে শিশুর কুঁজো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ও থাকে।এছাড়া আর্কাইভস অব চিলড্রেনের গবেষণায় দেখা গেছে ভারী স্কুল ব্যাগ বহনের ফলে শিশুরা নানা সমস্যায় পড়েছে।তাদের মতে,স্কুল ব্যাগ একজন শিশুর মোট ওজনের ১০ ভাগ হওয়া উচিত।যদি তা না হয় একসময় শিশুর শারীরিক জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।যার রেশ বৃদ্ধ বয়সে ও থাকবে।
কিছুদিন আগে সরকারী অনুমোদনহীন বই ও শিক্ষা সরঞ্জামের ওপর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এক সতর্ক আদেশ জারি করেছিল।যেখানে স্পষ্ট করে বলাছিল সরকারী অনুমোদনহীন বই বা শিক্ষা সরঞ্জাম শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।বিষয়টি নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।মহামান্য হাইকোর্ট ও শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি স্কুল ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করে,এবং এ বিষয়ে তৎপর হতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিল।তখন শিশুর স্কুল ব্যাগ নিয়ে নানান মহলের তৎপরতা দেখে খুবই আশাবাদী হয়েছিলাম।ভাবলাম এইবারৃ বুঝি অবুঝ বাচ্চাগুলো রেহাই পাবে।মুক্তি মেলবে ব্যাগ নামক ভারী বোঝার কাছ থেকে।মহামান্য আদালতের নির্দেশের সাথে সাথে সংবাদ মাধ্যম ও বিভিন্ন মহলের দৌঁড়ঝাপ দেখেও তাই মনে হয়েছিল।কিন্তু বিধিবাম!নির্দেশ নির্দেশই রয়ে গেল।বিভিন্ন মহলের দৌঁড়ঝাপ ও থেমে গেল।আমাদের সংবাদমাধ্যম ও এ বিষয়ে নেতিয়ে গেল। এত কিছুর পরও ভারী ব্যাগ থেকে নিস্তার মেলেনি ক্ষুদে কোমল কাঁধগুলোর।
তবে এ নিয়ে অভিভাবকরা মনে করেন তারা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অসহায়।ঐ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কাঠামোই বাধ্য করেছে তাদের শিশুদের ভারী ব্যাগ বহন করতে।কারণ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিলেবাস প্রণয়ন করা হয় সরকার অনুমোদিত ও অনুমোদনহীন বই দিয়ে।কাজেই অনুমোদিত ও অনুমোদনহীন নানান রকমের বই,খাতা ও ড্রয়িং এর সরঞ্জাম একত্রে মিলে একটা ভারী বোঝার মতো হয়ে যায়।তার ওপরে আছে টিফিন বক্স ও পানির বোতল।যা মাঝেমধ্যে শিশুর মোট ওজনকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়!
তবে এ বিষয়ে শিক্ষাবিদরা মনে করেন যদি শিক্ষামন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেে পাঠ্যসূচি নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে দেয় এবং তা না মানলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে,তাহলে ভারী ব্যাগ থেকে রেহাই পাবে কোমলমতি শিশুরা।অভিভাবকরাও শিক্ষাবিদদের সাথে একাত্ম পোষণ করেন।
তবে কথিত আছে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সুযোগ সুবিধা না পাওয়ার কারণে,বিভিন্ন প্রকাশনার কাজ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের ছাপা বইগুলো পাঠ্যসূচিতে অনর্ভুক্তি করান।
যে পড়ালিখা শিশুরা শেখার জন্য উৎফুল্ল হয়ে স্কুলে যাবে,সে পড়া লিখা শেখার জন্য তারা আজ স্কুলে যাচ্ছে ঠিক।তবে ভারী বইয়ের বোঝা নিয়ে!তাদের কাছ থেকে আমরা আনন্দের শৈশবটুকু কেড়ে নিয়ে তাদের অনিচ্ছার সত্ত্বেও তাদের কাঁধে তুলে দিয়েছি বইয়ের পাহাড়।এটাও কি শিশুর প্রতি এক ধরনের শারীরিক নির্যাতন নয়।
লেখক;হিমু চন্দ্র শীল
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ,কক্সবাজার সরকারী কলেজ।