
কত বড় মাছ,কি সুন্দর!ঢুকেই শুরু করে দিল হৈচৈ।সে কি আনন্দ তাদের চোখেমুখে,দেখে আমি নিজেও বেশ উদ্ভাসিত হয়েছিলাম।এর আগে এই সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা এমন একটা জায়গায় গিয়েছে বলে আমার মনে হয়না,অথচ ঐ একই পথ দিয়ে তারা প্রতিদিন যাতায়াত করতো,ভাঙারি কুঁড়াতো।হয়তো বাহির থেকে এক পলক দেখে নিয়ে মনে মনে ভাবতো ঐ জিনিসটার মধ্যে এমন কি আছে যে,মানুষ যেটা দেখার জন্য এত টাকা খরচ করে।আপনিই চিন্তা করে একবার দেখুন না,তারা ওখানে ঢুকবেই বা কি করে।যেখানে প্রবেশ করতে লাগে তাদের তিন চার দিনের ভাঙারি কুঁড়িয়ে আয় করা অংকের সমান টাকা।জন্মই যাদের আজন্ম অভাব নিয়ে,সেখানেতো এইসব বিলাসিতা বা বিনোদন তাদের পক্ষে সম্ভব না।কিন্তু তাদের স্বপ্নটা পূরণ হতে বেশি সময় লাগেনি।দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ফিস এ্যাকুয়ারিয়াম রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ আমাদের কক্সবাজার নতুন জীবন সংগঠনের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের সুযোগ করে দিল বিনামূল্যে সাগর জলের নানান প্রাণী নিজ চোখে দেখার।সেদিন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের প্রতি রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।যেখানে আজকাল পথশিশুদের দেখলে মানুষ দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়,কিংবা টোকাই বলে হেলাচ্ছলে অবহেলা করে কটূক্তি করে।সেখানে এতগুলো পথশিশুকে বিনামূল্যে রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ দেখতে দিল ফিস এ্যাকুয়ারিয়াম।যা বলতে গেলে একটা দৃষ্টান্ত। কেমন ছিল সেই আনন্দঘন মুহূর্তটা?আজ আপনাদের শুনাবো সেই গল্প।
বেশ কয়েকদিন আগে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের সাথে গেলাম দেশের প্রথম ও একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের ফিস এ্যাকুয়ারিয়াম রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ডে।যেটি বাংলাদেশে এই প্রথম সাগর জলের নানান প্রাণী স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।বিশাল জায়গার উপর নির্মিত এই রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ডের চারিদিকে বিশাল বিশাল গ্লাস বাঁধানো ফিস এ্যাকুয়ারিয়াম।এক একটি এ্যাকুয়ারিয়ামে দলবদ্ধভাবে জীবন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগরের মাছ,কাঁকড়া,চিংড়ী,অক্টোপাস,শামু
ক,কচ্ছপসহ আরও বিভিন্ন রকমের প্রাণী।দেখে মনে হবে এ যেন সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ সমুদ্র দর্শন।বিকেল হতে না হতেই আমাদের সংগঠনের ক্ষুদে বন্ধুরা এসে হাজির নির্ধারিত স্থানে।চারিদিকে একটা হৈহৈরৈরৈ রব।এমনিতে তারা সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে পরিস্থিতি তাদের দস্যিপনা একটু বেশি করতে শিখিয়েছে।কিন্তু ঐ যে কথায় আছে অকৃত্রিম ভালোবাসা বনের পশুকেও পোষ মানায়,ঠিক তেমনি সংগঠনের সবার ভালোবাসা আজ তাদেরকে একটু হলেও শিখিয়েছে শৃঙ্খলার সহিত চলতে।আমরা বলতে না বলতেই তারা সবাই সুশৃঙ্খল হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল।যেহেতু রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড আমাদের কাছ থেকে বেশি দূরে নয়,তাই মুহূর্তের মধ্যে তাদের সবাইকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ডে পৌঁছানোর পর মিনিট কয়েক তাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিলাম।তারপর সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কর্তৃপক্ষসহ তাদের সাথে ছবি উঠালাম।এইবার আসল সে মুহূর্তটি,যেটি ছিল উত্তেজনার পারদে পারদে ঢাকা।সবাইকে লাইন করে সারিবদ্ধভাবে ঢুকিয়ে দিলাম তাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ডে এ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে।সাথে কিন্তু আমরাও বাদ যায়নি।ঢুকেই তারা হৈহুলোড় শুরু করে দিল।কেউ বলছে ওমা কত্ত বড় মাছ,আবার কেউ ওরে বাপরে কি সুন্দর!আর ঐদিক দিয়ে আমরাও বাচ্চাটি হয়ে তাদের মিষ্টি দুষ্টমিগুলোকে অলিখিত সায় দিয়ে দিলাম।সাথে পকেট থেকে যার যার মোবাইল ফোনটা বের করে তাদের সাথে ইচ্ছেমতো বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলতে লাগলাম।চারিদিকে বিভিন্ন রকমের মাছ ভর্তি এ্যাকুয়ারিয়াম।ঝিলিমিলি নানান লাইটের আলোতে এ্যাকুয়ারিয়ামের সৌন্দর্যটা আরও উপভোগ্য করেছে।সেই আলোতে মাছের দলবল বেঁধে ঘুরাঘোরি,লাফালাফি সৌন্দর্যটাকে আরও দ্বিগুন করে তুলেছে। আমাদের শিশুরা চোখে মুখে কৌতূহল ও রোমাঞ্চ নিয়ে ঢ্যাপ ঢ্যাপ করে দেখছে আর দেখছে।মাঝে মধ্যে একে অপরকে বলছে;এই তুই মাছ এইটা খেতে পারবি?বিপরীত দিক হতে উত্তর আসল,ওবাপ!এইটা খাওয়াতো দূরে থাক,এর কাছে গেলে উল্টে আমাকে গিলে খাবে।সাহস থাকলে তুই খেয়ে দেখানা।অপরজন নিমিষেই চুপ হয়ে গেল।তাদের সেই সহজ সরল কন্ঠে মায়াবি মাখা কথাগুলো শুনতে খুবই মজার ছিল।আর আমরা তাদের সামনে মজার মজার অঙ্গভঙ্গি করে তুলে ধরতে লাগলাম বিভিন্ন রকমের মাছ ও প্রাণীগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের তথ্য।
এ্যকুয়ারিয়াম দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা ঝটলার দিকে।মনে মনে ভাবলাম কি এমন হয়েছে!গিয়ে দেখি বাচ্চারা সবাই ফিডার নিয়ে কাঁড়াকাঁড়ি করতেছে।কেউ বলছে আগে আমি খাওয়াবো,আবার কেউ বলছে না আগে আমিই খাওয়াবো।আর কতগুলো বাচ্চা এইসব ঝামেলার মধ্য থেকে বের হয়ে নিজেদের হাতখানা আস্ত ঢুকিয়ে দিল এ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতর!না এখানে অবাক হওয়ার মতো তারা তেমন কিছুই করেনি।তাদের উদ্দেশ্য গোল্ড ফিসগুলো যাতে ফিডারভেবে তাদের আঙ্গুলগুলো চুষতে থাকে।এইবার ব্যাপারটা আমার কাছে একটু খোলাসা হলো।উল্লেখ্য রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ডের পুরো এ্যাকুয়ারিয়াম জুড়ে শুধুমাত্র এই এ্যাকুয়ারিয়ামের উপরিভাগ খোলা।মানে এই এ্যাকুয়ারিয়ামটি এমনভাবে বানানো যাতে দর্শনার্থীরা গোল্ড ফিসের নির্ধারিত তরল খাবার ফিডারে ভরে গোল্ড ফিসকে খাওয়াতে পারে।ঝটলার মধ্যে ঢুকে সবাইকে শান্ত করলাম।বললাম সবাই একএক করে খাওয়াতে পারবে।গোল্ড ফিসকে খাওয়ানোটা ও ছিল একটা দেখারমতো দৃশ্য।পানিতে ফিডার দিতেই ঝাঁক বেঁধে মাছের দল এসে হাজির।কে কার আগে সাবাড় করবে এ নিয়েই তাদের মধ্যে চলে দ্বন্দ্ব।মাঝেমধ্যে দু’একটা গোল্ড ফিস লাফও দেয়।গোল্ড ফিসকে খাওয়ানো শেষ করে সবাই চলে গেলাম বনে!কি অবাক হয়েছেন তাই না?মনে মনে ভাবতে লাগলেন এ আবার কেমন কথা।এখানে আবার বন আসল কেমন করে।আসলে কর্তৃপক্ষ এ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতর প্রাকৃতিক আবহ আনার জন্য এই কৃত্রিম বনটি তৈরি করেছে।বনে কুমির থেকে শুরু করে হরিণ,কি নেই।তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় বনে বিভিন্ন জীবজন্তুর পাশাপাশি সাথে একটি কৃত্রিম ঝরণাও তৈরি করেছে।কতগুলো মাছ নিয়ে প্রাকৃতিক সুদৃশ্য কৃত্রিম ঝরণাটিও দেখতে খুবই চমৎকার।অবশ্য প্রাকৃতিক ঝরণাতে স্নান করতে পারলেও,এই কৃত্রিম ঝরণাতে স্নান করার কোনো সুযোগ নেই।তবে বনও ঝরণার ধারণাটি মন্দ নয়।মিনিট কয়েক ঝরণাও বনে ঘুরাঘুরি করার পর অবশেষে বের হয়ে আসার পালা।সব শিশুদের লাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের নতুন জীবন সংগঠনের সদস্যরা একএক করে সবাইকে বের করে আনল।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল,হয়তো লাইটের উজ্জ্বলতায় অন্ধকারটা ভালো করে উপলব্ধি করতে পারলাম না।কিন্তু শিশুদের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখে এটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারলাম যে আজকের দিনটা তাদের মন্দ কাটেনি।একজন অপরজনকে বলতে শুনলাম ভাই কি যে সুন্দর ছিল এ্যাকুয়ারিয়ামটি।অপরজন তার কথা শেষ না হতেই মুখ থেকে কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল আজকে আমি বাসায় গিয়ে সবাইকে বলবো দেখিস।
শিশুদের চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ দেখে আমরা (সদস্যরা)বড়রাও মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম।তবে পরক্ষনেই মনে একটু দুঃখ হলো!কারণ এই আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী।আজকের দিনটি হয়তো তারা আনন্দ করে কাটাতে পারছে।কিন্তু কালকে?কালকে ঠিকই তারা পেটের দায়ে বস্তা কাঁধে নেমে যাবে দু’মুটো অন্ন জোগাতে।আজকের হাসিখুশি মুখটি হয়তো কালকে মলিনতায় ভরে যাবে।জানিনা আগামী তাদের জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে।কিন্তু এইটুকু জানি আমি,আমরা সর্বোপরি নতুন জীবন সংগঠনের সদস্যরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন পথশিশুদের জন্য হৃদয়ে ভালোবাসা নিয়ে বসে থাকবে।শিশুদের বিদায় জানিয়ে এইবার সকলে পা বাড়ালাম নিজ গন্তব্যে।ও হ্যাঁ এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের জন্য বেশ কয়েকটি সুযোগ সুবিদা রেখেছে।তিন ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার নিচের বাচ্চাদের জন্য এ্যাকুয়ারিয়ামে প্রবেশ মূল্য ফ্রী।পাশাপাশি এস.এস.সিতে যারা জিপিএ চার ও এর উপরে পেয়েছে তারাও বিনামূল্যে রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড দেখতে পারবে।সাথে কিন্তু রেজাল্ট প্রমাণ করার জন্য রেজাল্ট কপি লাগবে।
লেখক;হিমু চন্দ্র শীল
ছাত্র;কক্সবাজার সরকারী কলেজ।