হিমু চন্দ্র শীল
মাঝে মধ্যে আমাদের দেশের খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনে দেশের শিশুদের নিয়ে কোনো একটা ভালো নিউজ দেখলে বেশ খুশি হই।মনে মনে বলি যাক অন্তত এইবার হলেও আমাদের দেশের শিশুরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিশুদের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।এই বুঝি আমাদের দেশের শিশুরাও বিশ্ব জয় করে ফেলবে।তৃষ্ণার্ত মনে যখনি তৃপ্তির ঢেকুরটা তুলতে যাবো,ঠিক তখনি এই দেশে শিশুদের প্রতি নির্যাতন কিংবা শিশুদের জীবন যাত্রার মানের পরিসংখ্যান দেখে নিমিষেই সে আশা উদাও হয়ে যায়।এই বয়সেই তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা,কিংবা বুকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা।কিন্তু না!তারা আজ অমনুষত্ব আর দারিদ্র নামক এক অদ্ভুত শব্দের কাছে হেরে গিয়ে ক্ষুদে হাতে বইয়ের বদলে তুলে নিয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।হ্যাঁ আমি তাদের কথাই বলছি,যারা এখনও জানে না কাজ কি।মেধাবী জাতি তৈরিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে এটিকে বিবেচনা করার এখনি সময়।
বেশ কিছু দিন আগে ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘সাগর তীরের গয়না বিক্রেতা ওরা’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে দেখলাম ছোট ছোট শিশুরা ট্রে হাতে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে শামুক-ঝিনুকের সামগ্রী বিক্রি করতেছে।প্রতিবেদনটিতে রবিউল নামের একটি শিশুর সহজ সরল উক্তি হলো ‘তাদের সাথে সবাই ভালো ব্যবহার করলেও মাঝে মধ্যে কিছু দুষ্ট লোক গয়না নিয়ে টাকা দেয় না;তখন মালিক মনে করে তারা টাকা চুরি করেছে।ফলে মালিকের মারধর খেতে হয় তাদের’।হ্যাঁ কথাটি একেবারে সত্যি।আমি অনেক সময় নিজের চোখে দেখেছি শিশুদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে এই জঘন্য কাছটি করে থাকে।ফলে মিথ্যে চুরির অপবাদ নিজের ঘাড়ে নিয়ে অনেক সময় মালিকের প্রহার সহ্য করতে হয় এই অবুঝ শিশুদের।এমন একটি ঘটনা আমার সাথেও ঘটেছে। কিছুদিন আগে বীচের কিটকট চেয়ারে বসে আছি।এমন সময় চিপস হাতে একজন শিশু এসে বলে ভাইয়া একটা চিপস নেন।পকেটে ভাংতি টাকা না থাকার কারণে তার কাছ থেকে চিপস নিতে চাইলাম না।কিন্তু শিশুটি বলল ভাইয়া সমস্যা নাই,আপনি চিপস নেন।আমি বাকি চিপসগুলো বেচে আসি।আর ততক্ষনে টাকা ভাংতি হয়ে যাবে।তার জোরাজুরির সত্ত্বে আমি তার কাছ থেকে একটি চিপস এর প্যাকেট নিলাম।আর তার হাতে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম যাও ভাংতি নিয়ে আস।শিশুটি মোটেও টাকাটি নিলনা।বরং আমাকে বলল ভাইয়া আপনি বসে বসে চিপসটি খান।আমি অবাক হয়ে গেলাম!বেশ কিছুক্ষন পর শিশুটি বেচা-বিক্রি শেষ করে যখন ফিরে আসল টাকা নেওয়ার জন্য,তখন তাকে কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসালাম।বললাম দেখ তুমি যে আমাকে বাকিতে এইভাবে চিপস দিয়ে চলে গেলে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো তোমার টাকা না দিয়ে চলে যেতে পারতো।তখন তো তোমার ক্ষতি হতো,তুমি এইরকম আর করো না।শিশুটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিয়ে চলে গেল।
বীচে যারা বেচা-বিক্রী করে তারা সবাই দরিদ্র ঘরের সন্তান।প্রতি শুক্রবার কক্সবাজার শহিদ মিনারে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে পড়ানোর ফলে খুব কাছ থেকে তাদের সাথে আমার মেশার সুযোগ হয়।তখন তাদের কাছে গিয়ে তাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো শুনতে চেষ্টা করি।দেখা যায় তাদের সবার গল্পগুলো এক।সবার কাজ করার প্রধান কারণই হলো দারিদ্র আর অভিভাবকের অসচেতনতা।ফলে তারা পড়া-শুনায় বেশি দূর এগোতে পারে না।
এই দেশের শিশুরা কতটা নাজুক অবস্থায় আছে তা এই তথ্য দেখলেই বুঝা যায়।সাম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বা আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে বস্তির শিশুদের ৮৬ শতাংশ খাবারে ক্ষতিকর জীবাণু রয়েছে।বস্তির শিশুদের দৈনন্দিন খাবার তারা পরিক্ষা করে পান ফিকাল কলিফর্ম,এককোষী ছত্রাক,ফাঙ্গাসের মতো প্রাণঘাতী নানান জীবাণু।যার ফলে বস্তির শিশুরা সবসময় বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছে।বারবার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে তাদের শরীরের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়ে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।এমনকি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নও ব্যহত হচ্ছে। ফলে এই দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আগামীতে মেধাবী ও কর্মক্ষম প্রজন্ম তৈরিতে একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হতে পারে এই দেশের জন্য।
মেধাবী নতুন প্রজন্ম তৈরিতে আরো একটা বড় চ্যালেঞ্জ ধূমপান।ধূমপান এখন এতটা প্রকট আকারে ছড়িয়েছে যে শিশুদেরও এর হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্রতিনিয়ত তাদের শরীরে প্রবেশ করছে নিকোটিনের মতো বিষাক্ত এক মরণঘাতী পদার্থ।ভাবুনতো একবার যে পুঁচকেরা নিকোটিন কি তা জানে না,তাদেরই ক্ষুদে শরীরে জায়গা করে নিয়েছে এক মরণ ঘাতক পদার্থ।পুঁচকেদের কথা বাদই দিলাম,আমরা বড়রাই বা কজন এগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছি।নিকোটিন হলো এক ধরণের ঘাতক পদার্থ,যা সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে থাকে।কিন্তু অন্য কোনো ধোঁয়ার মধ্যে থাকে না।নিকোটিন শব্দটি এসেছে,১৫৫৭ সালে যখন পর্তুগালের লিসবনে এক অনুষ্টানে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জিন নিকোট তামাকের ঔষুধী গুণের প্রশংসা করেন তখন তার সম্মানার্থে ফ্রান্সে তামাকের নিকোটিনা নামের উৎপত্তি হয়। তাই বলে এই না যে ঐ শিশুরা ধূমপান করে।এর কারণ পরোক্ষ ধূমপান।পরোক্ষ ধূমপান দু ভাবে হয়।এক;জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া(Side stream smoke)দুই;ধূমপায়ীর মুখের ভিতর থেকে নির্গত ধোঁয়া(Main stream smoke)।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড হতে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীর প্রতিবেদনের মতে ঢাকার বারোটি স্কুলের ৪৭৯ জন শিশুর লালার মধ্যে ৪৫৩ জনের লালায় এই ঘাতক পাওয়া যায়।কি শুনে অবাক লাগছে?মোটেও না।একবার ভাবুনতো স্কুলে পড়ুয়াদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে যারা স্কুলে যায় না তাদের কি করুণ অবস্থা হবে?দেশে শিশুরা পরোক্ষভাবে মাদকের যেমনি শিকার হচ্ছে তেমনি প্রতক্ষ্যভাবে আরও বেশি হচ্ছে।আপনি চেনেন ড্যান্ডি কি?নিশ্চয় না।কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ পথশিশু যারা ঢাকা শহরে থাকে তারা জানে ড্যান্ডি কি।কারণ তারা ড্যান্ডি কে মাদক হিসেবে গ্রহণ করে।ড্যান্ডি হলো জুতা তৈরির কারখানায় জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত আঠা।এতে টলুইন নামে একধরনের উপাদান আছে যা মাদক দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত।শুধু ড্যান্ডি নয় তারা আজকাল সিসা পর্যন্ত গ্রহণ করে।চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট এর মতে একবার সিসা গ্রহণ করলে শরীরে যে পরিমাণ নিকোটিন প্রবেশ করে ,তা একশটি সিগারেটের সমান।ধূমপান এতটা প্রকট আকার ধারণ করেছেযে অধিকাংশ তরুণ তরুণীরা এই বদমায়েশী নেশাটাকে আধুনিকতার ছোঁয়া হিসেবে তাদের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে জায়গা দিয়েছে।ফলে ধ্বংসের মুখে এই সমাজ।
যখনই আমাদের দেশে আনকোরা পূষণ উঁকি দিয়ে দেশটাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়,তখনই এই সব প্রতিবেদন আমাদেরকে মর্মাহত করে।শিশুদের শরীরে নিকোটিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে,তার মানে এই নয় যে বড়দের(আধূমপায়ী)শরীরেও থাকবেনা।আমরা যারা ধূমপান করি না তারা মোটেও নিরাপদ নয়।ধূমপায়ী বন্ধুবান্ধবদের সাথে কিংবা জনসমক্ষে,রাস্তা ঘাটে আমরা প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার হই।একজন ধূমপায়ীর সাথে যদি আর একজন অধূমপায়ী এক ঘণ্টা থাকে,তাহলে সে যে পরিমাণ ডাইমিথেন নাইট্রোসামাইন নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করবে তা ৫০ টি সিগারেটের সমান।এইবার ভাবুন অধূমপায়ী হয়েও আমরা প্রতিদিন পরোক্ষভাবে কি পরিমাণ ধূমপানের স্বীকার হচ্ছি।আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত মানুষেরা মনে করে দামী বিদেশী ফিল্টারযুক্ত সিগারেটে তেমন কোন ক্ষতি হয় না।যা একেবারে ভুল।সিগারেটে ফিল্টার ব্যবহারের ফলে নিকোটিন এবং টারের পরিমাণ কমে।কিন্তু ফিল্টারবিহীন সিগারেটের ধোঁয়ায় যে পরিমাণ কার্বন মনো অক্সাইড থাকে, ফিল্টারযুক্ত সিগারেটে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে কার্বন মনো অক্সাইড থাকে।
আমার মতে মাদক জগতে পা রাখার সোপান হলো ধূমপান।কারণপ্রতিটি মানুষের কৈশোরে অজানাকে জানার আগ্রহ থাকে।তখন তারা প্রকাশ্যে ধূমপান দেখে কৌতূহলী হয়ে ঐনেশাটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়।যা পরবর্তীতে মাদক জগতে ঢুকতে সহায়ক হয়।
ফলে এই দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আগামীতে মেধাবী ও কর্মক্ষম প্রজন্ম তৈরিতে একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হতে পারে এই দেশের জন্য।
এত সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার পরও আমরা স্বপ্ন দেখি নতুন এক বাংলাদেশের।এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে হয়তো কোনো একদিন বাংলাদেশ দাঁড়াবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারে।আগামীতে গড়ে উঠবে অনিন্দ্য সুন্দর এক ভবিষ্যত প্রজন্ম।
লেখক:হিমু চন্দ্র শীল।শিক্ষার্থী,কক্সবাজার সরকারী কলেজ।