শব্দঘর ঈদ সংখ্যায় নতুন লেখকদের কাছ থেকে উপন্যাস পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল তা আমাদের মোটামুটি লেখালেখির সাথে সংযুক্ত এমন সকলেরই জানার কথা। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছিল, নির্বাচিত সেরা উপন্যাসটি শব্দঘর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। পাশাপাশি সেটি বই আকারে প্রকাশিত হবে আগামী ২০১৮ বইমেলায় অন্য প্রকাশ প্রকাশনী থেকে। ঈদ পেরিয়ে বছর এখন গোধূলি লগ্নে বলা চলে। এরইমধ্যে সবার জানাও হয়ে গেছে শব্দঘরের নির্বাচিত উপন্যাসটি হচ্ছে লেখক “আশান উজ জামান” এর “অন্য চোখে”।
“অন্য চোখে” উপন্যাস নিয়ে আমি সত্যিই বলার কিছু যোগ্যতা আদৌও রাখি না। কারণ, উপন্যাসটি যাঁরা নির্বাচিত করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন বাংলাদেশ সাহিত্য জগতের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তাঁদের বিচারে ভুল হবার প্রশ্নই আসে না। তবে পাঠক হিসেবে আমি কিছু কথা বলতেই পারি। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমি পাঠক হিসেবেই “অন্য চোখে” কেমন লেগেছে সেটা বলবো। তবে লেখায় মুগ্ধ হবার গল্পের আগে লেখকে মুগ্ধ হবার গল্পটা খানিক বলা যাক। শব্দ ঘরে “অন্য চোখে” প্রকাশিত হওয়ার খবর জানার পর লেখকের নাম লিখে গুগলে সার্চ দিতেই তাঁর লেখা “উড়োতিথি” নামের একটি গল্প সামনে আসলো। গল্পটা অনেকটা বিরূপ মনোভাব নিয়েই পড়া শুরু করলাম। কি এমন লেখেন উনি দেখি যে সেরা উপন্যাস হিসেবে তাঁর লেখাটাই নির্বাচিত করা হলো! বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম পুরো লেখাটাই এবং পড়া শেষে কয়েক সেকেন্ড মাথাটা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছিল। এটাকে অসাধারণ বললেও কিছু কম বলা হয়।
পরবর্তীতে ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে এ্যাড হলাম। টাইমলাইন থেকে পোস্ট করা আরও কিছু গল্পও পড়লাম। অনুভূতিগুলো বলতে পারবো না। উনার প্রতিটা গল্প পড়েই আমার মনে হয়েছে অসাধারণ শব্দটা কম হয়ে যায়। এদিকে আমি অসাধারণ এর চাইতে বেশি প্রশংসনীয় কোন শব্দও জানি না। কিন্তু গল্প খুব ভালো লিখলেই যে লেখক উপন্যাস কবিতাও ভালো লিখবেন এমন কোন কথা নেই। তাই বুঝতে পারছিলাম না সত্যিকার অর্থে আগামীতে সাহিত্য জগতকে নেতৃত্ব দিতে আসছেন কে! বলে রাখা ভালো, শব্দঘর কর্তৃক আয়োজিত এত বড় একটা প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হবেন যিনি, তার ওপর আবার অন্য প্রকাশ এর ব্যানার থেকে সেই লেখা যার বই আকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেটা নিঃসন্দেহে আগামী সাহিত্য জগতকে নেতৃত্ব দেবার মতনই কোন লেখকের লেখা হওয়া বাঞ্ছনীয়। তখনো উপন্যাসটি আমার পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
ঈদ শেষে চট্টগ্রাম ফিরতে ফিরতে বেশ দেরী হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে ঈদ সংখ্যাটা আর কোথাও খুঁজে পাইনি। তবে মনের ভেতর উপন্যাসটা পড়ে দেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। কিন্তু কিছুই করার নেই! শেষ সুযোগ একেবারে বইমেলা ২০১৮ থেকে বই আকারে উপন্যাসটা কিনে পড়ে দেখার। হয়তো তাই হতো যদি এমনটা না ঘটতো- লেখকের সঙ্গে তখনো কথা বলা হয়ে ওঠেনি কিংবা পরিচয়ও হয়নি আমার। তিনি কোন এক ভাবে জানতে পেরেছিলেন আমি তাঁর লেখা উপন্যাসটা পড়তে ভীষণ আগ্রহী। উনি আমাকে না জানিয়েই আমার ঠিকানা যোগাড় করে কুরিয়ারে একটা সৌজন্য সংখ্যা পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। আমি রীতিমত মুগ্ধ এবার। আমার মত অপরিচিত একজনকে ঈদ সংখ্যার একটা কপি না পাঠালেও তিনি পারতেন। আগ্রহটা যখন আমারই বেশি, তখন সময় হলে বই মেলা থেকে কিনে উপন্যাসটা আমি পড়ে দেখতামই। কিন্তু উনি আমাকে এতটা অপেক্ষা করালেন না। জানা মাত্রই উপন্যাসটা পড়ার ব্যবস্থা করে বিনয়ের পরিচয় দিলেন। আর আমি তাঁর লেখা গল্পের প্রতি মুগ্ধ থাকা পাঠক থেকে নিমিষেই হয়ে উঠলাম লেখকের প্রতি মুগ্ধ।
একজন লেখক তখনই সাহিত্য জগতে পাকাপোক্ত হন, যখন তিনি অসাধারণ ভঙ্গিমায় নিজের অনুভূতিগুলোকে লেখার আকারে তুলে ধরতে পারেন। আর একজন লেখক তখনই পাঠকের মনে পাকাপোক্ত হন, যখন তিনি নিজের লেখার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিত্ব দ্বারাও পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারেন। এই যে নিজের লেখার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে লেখক আমাকে মুগ্ধ করে ফেললেন, এখান থেকেই সম্ভবত তাঁর সাহিত্য জগতে পাকাপোক্ত হওয়ার কথা জানান দেয়া শুরু করলেন তিনি। কারণ, তিনি তো তাঁর লেখার পাশাপাশি নিজেও পাঠকের মনে নিজের জন্য ভালোবাসার জন্ম দিয়ে দিলেন এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।আর লেখার পাশাপাশি লেখক স্বয়ং যখন পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পারেন তখনই তাঁর লেখক সত্তার প্রকৃত জাগরণ ঘটে বলে আমি মনে করি। এখন আসি “অন্য চোখে” উপন্যাসের কথায়। লেখক আমাকে তাঁর লেখাটি অনেক আগেই পড়ার সুযোগ করে দিলেও মাঝখানে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় উপন্যাসটা সম্পূর্ণ শেষ করতে করতে অনেকদিনই লেগে গেল ।
পড়া শেষে বেশ ভালো লেগেছে বলতে চাই না। বলতে চাই বেশিই ভালো লেগেছে। নাহ মোটেও লেখকের বিনয়ে মুগ্ধতার রেশ উপন্যাসের ওপর এসে পড়েনি আমার সেটা কথা দিতে পারি। তার প্রমাণ স্বরূপ বলতে পারি উপন্যাসটা পড়া শুরুর দিককার একটা ঘটনা। ঈদ সংখ্যাটা হাতে পাওয়ার পর পরীক্ষার মাঝেই একবার হাতে নিয়ে “অন্য চোখে” পড়তে শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকের চারটা অংশ পড়ে আমি কিছুক্ষণের জন্য ঘুমাবো বলে চোখ বন্ধ করেছি। কিন্তু উপন্যাসের রেশটা আমার মাঝে এতটাই প্রবল ভাবে জেঁকে বসেছিল যে, ঘুমের ঘোরেই আমি যেটুকু উপন্যাসের কাহিনী পড়ে শেষ করেছিলাম, এরপর থেকে নিজের মত করে প্রেক্ষাপট সাজিয়ে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। সত্যি বলতে আমি যখন কোন লেখা পড়ি তখন বেশ অনেকটাই সেই লেখার কাহিনীর ঘোরের মধ্যে থাকি। তবে কিছুটা পড়া কাহিনীকে ঘুমের ঘোরে নিজের মত করে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণতা দেয়ার ঘটনা কখনোই ঘটেনি আমার সাথে। শুরুতেই আমার চোখে “অন্য চোখে” এতটাই মোহ জাগিয়েছিল যে উপন্যাসটাকে নিজের কাহিনী মনে করে নিজের মত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছিলাম আমি এবং সেই মোহ আজ উপন্যাস শেষেও কাটিয়ে উঠতে পারছি না।
লেখকঃ মুনতাসির সিয়াম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Comments are closed.