শিশুদের সামনে ধুমপান মানে ওদের সর্বনাশ!।১১ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে ‘৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরের নিকোটিন’। খবরটিতে যা বলা হয়েছে, তাতে আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে গেছে। একটি যৌথ গবেষণার তথ্য, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশপাশের এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে নাকি ক্ষতিকর নিকোটিনের উপস্থিতি রয়েছে আর এর পেছনের কারণ হচ্ছে পরোক্ষ ধূমপান। এর মানে হচ্ছে এই শিশুরা ধূমপান করে না। কিন্তু তার আশপাশে থাকা লোকজন ধূমপান করে আর সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে ক্ষতিকর নিকোটিন।
এ যৌথ গবেষণায় ৪৩ শতাংশ শিশু বলেছে, তার পরিবারে কমপক্ষে একজন ধূমপান করে। ২১ শতাংশ শিশু বলেছে, তার পরিবারে সদস্য ও অতিথিদের ধূমপান নিষেধ। ৮৭ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা সম্প্রতি জনসমাগমের স্থানে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে আছে দোকানে, রাস্তায় পরোক্ষ ধূমপান করা।
ভাবুন তো একবার, ধূমপান না করেও এই শিশুরা কী মারাত্মক স্বাস্থ্য-সমস্যায় পড়েছে। শরীরে নিকোটিন যাওয়ায় এই শিশুরা এখন হৃদ্রোগের ঝুঁকিতে পড়বে। তাদের ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানিসহ অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগ দেখা দিতে পারে। নিকোটিনের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। তাদের প্রজনন অঙ্গের ক্ষতি হবে, দেখা দেবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বধিরতা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, ঝিমুনি। ব্যাহত হতে পারে তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ও মানসিক বৃদ্ধি। আর সবার ওপরে ক্যানসার তো রয়েছেই। মোট কথা, নিকোটিন হচ্ছে বিষ। বিষ খেলে যেমন মানুষের মৃত্যু হয়, তেমনি নিকোটিন গ্রহণ করলেও মানুষ মারা যায়। কী ভয়ংকর কথা! যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁরা কি বুঝতে পারছেন এর বিপদটা কোথায়? উপলব্ধি করতে কি পারছেন এই ৯৫ শতাংশ শিশু কতটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে?
পরোক্ষ ধূমপানে গর্ভস্থ সন্তানেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। কারণ, গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে যে রক্ত বাহিত হয়, তার অক্সিজেনের ধারণক্ষমতা কমিয়ে দেয় তামাকের কার্বন মনোক্সাইড। নিকোটিন গর্ভফুলের রক্ত সরবরাহ হ্রাস করে। ফলে মায়ের শরীর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে যেতে পারে না, তাই শিশুর বৃদ্ধিও ব্যাহত হয়। এ ছাড়া ধূমপানের কারণে গর্ভপাত কিংবা অপরিণত শিশু জন্মাতে পারে। এই অপরিণত শিশুরা আবার সংক্রমণ বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
ধূমপানের এসব কুফল সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ যে একেবারেই কিছু জানে না, তা তো নয়। সবাই কমবেশি জানি। তারপরও আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, জেনেবুঝেও অনেকে দেদার ধূমপান করে যাচ্ছেন। সিগারেটে সুখটান না দিলে যে তাদের কাজে মন বসে না, চোখে ঘুম আসে না। আবার অনেকের মতে, সিগারেট না খেলে তো স্মার্টই হওয়া যায় না। চেহারায় আসে না এক্সিকিউটিভ লুক। তাই ধূমপান করতেই হবে। এ এমনই এক নেশা, ভাত খাই আর না খাই সিগারেট খেতেই হবে। এ নেশা যে ছাড়া যায় না। ঘরে-বাইরে, জনসমাগমের স্থানে তাঁরা ধূমপান করেই চলেছেন।
এসব ধূমপায়ীর উদ্দেশে বলছি, আপনাদের সাময়িক নেশার জন্য আপনি যে কতজনের ক্ষতি করে চলেছেন, তা কি আপনারা জানেন? নিজেকে তো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেনই, অন্যদের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন। এটা আপনাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই পরিচয়। একজন দায়িত্বশীল মানুষ কখনো এ রকম করতে পারে না।
ধূমপায়ী বাবাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনি কি চান আপনার শিশুসন্তান অকালে মারা যাক? ধূমপায়ী মায়েদের বলছি, আপনি কি চান আপনার অনাগত সন্তানটির ক্ষতি হোক। নিশ্চয়ই চান না। আর তা-ই যদি হয়, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কোথাও ধূমপান করবেন না। এখনই ছেড়ে দিন ধূমপান।
এই যৌথ গবেষণার ফলকে সরকারকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে দেশে একটি আইন হয়েছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এখন সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করতে হবে। আইন লঙ্ঘনকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে না।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক
Comments are closed.