কিশোরী একটি মেয়ে। নাম মিয়া মনজিডেলিস। এখন যার বয়স মাত্র ১২ বছর। স্কুলের বন্ধুদের সাথে খেলা করে,টিভি দেখে আর রেস্টুরেন্টে গিয়ে মজার মজার খাবার খেয়ে দিন পার করা আর দশজন কিশোর কিশোরীর মত নয় সে। ফেসবুক,ইউটিউব,টিকটক বা ইন্সটাগ্রামে ছবি আর ভিডিও পোস্ট করা মিলিয়ন ভিউ পাওয়া তথাকথিত সেলিব্রেটিও সে নয়। তবুও সে সেলিব্রেটি। তবুও সে বিশ্বব্যাপী আলোচিত এবং প্রশংসিত! সে সবার থেকে বেশ আলাদা। কারণ এই বয়সেই সে প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। মনজিডেলিস মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পাওয়ারপনি আবিস্কার করেছিল। এখন আমাদের জানা দরকার এই পাওয়ার পনি জিনিসটা আসলে কী? পনি শব্দের অর্থ টাট্টু আর টাট্টু কথাটা বলার সাথে সাথে যে বিষয়টা মাথায় আসে সেটা হলো ঘোড়া। যে ঘোড়া খুবই ছোট তাকে আমরা টাট্টুঘোড়া বলি। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে মনজিডেলিস কিভাবে টাট্টুঘোড়া আবিস্কার করলো? এখানে একটি ছোট্ট তথ্য দিতে হচ্ছে। পনি শব্দের আগে সে পাওয়ার শব্দটি ব্যবহার করেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে পাওয়ারপনি হলো ব্যাটারি চালিত টাট্টুঘোড়া! হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। মিয়া মনজিডেলিস যেটা আবিস্কার করেছে সেটি হলো ব্যাটারি চালিত ঘোড়া। আর এই ঘোড়ায় চড়লে সত্যিকার ঘোড়ায় চড়ার মতই অনুভূত হয়। মিয়া মনজিডেলিস একই সাথে নিউইয়র্কে অবস্থিত “দ্য ফ্যামিলি এন্ড চিলড্রেন এসোসিয়েশন” এর মেম্বার। এটি একটি দাতব্য সংস্থা, যারা অসহায় শিশু কিশোর ও বয়স্কদের সহযোগিতা করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মিয়া গত বছর এই সংস্থাকে ৫ হাজার ডলার সাহায্য দিয়েছে এবং বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমান সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা! দ্য হেরাল্ড ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিলো ” আমি সব সময় অসহায় শিশু ও তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে ভালোবাসি”। আর আশ্চর্য বিষয় হলো তার এই সাহায্য দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল যখন তার বয়স ছিলো মাত্র ৩ বছর!
মনজিডেলিস ছোটবেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়তে পছন্দ করতো। তার ছিলো ঘোড়ার প্রতি দূরন্ত ভালোবাসা। কিন্তু মন চাইলেইতো আর ঘোড়ায় চড়া যায় না। বিশেষ করে ছোটরা ঘোড়ায় চড়তে গেলে কতরকম বিপদ হতে পারে। আর সে জন্য ছোটরা যখন ঘোড়ায় চড়ে তখন বড় কেউ না কেউ সাথে থাকতে হয়। কিন্তু দেখা গেলো বাবা অফিসে, মা রান্নার কাজে কিংবা বাজারে গিয়েছে এমন সময় ঘোড়ায় চড়তে ইচ্ছে করছে। তখন উপায় কি? একা একাতো ঘোড়ায় চড়তে পারবে না। ঘোড়ার পিঠেইতো উঠতে পারবে না। সুতরাং এমন একটা ঘোড়া দরকার যেটা হবে তার মত ছোটদের জন্য। যার পিঠে সে একা একাই উঠতে পারবে এবং যখন খুশি সে সেই ঘোড়ায় চড়তে পারবে। এমনকি মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তার যদি ইচ্ছে করে একটু ঘোড়ায় চড়বো তো কারো সাহায্য ছাড়াই সে একা একা সেই ঘোড়ায় চড়তে পারবে। কিন্তু এমন আজব ঘোড়া কি দুনিয়ার কোথাও একটাও আছে? ধরে নিলাম একটা আছে আর সেই ঘোড়াটা কোনো ভাবে মনজিডেলিসের জন্য সংগ্রহ করা হলো। সেটা দেখে যদি তার বন্ধুরা বলে তাদেরও অমন একটি ঘোড়া চাই। তখন কোথায় পাবে সেই ঘোড়া? বাবা মা তখন কষ্ট পাবে। মনজিডেলিসের উপর রাগ করবে। সুতরাং সে সিদ্ধান্ত নিলো এমন একটি ঘোড়া সে নিজেই তৈরি করবে! মাত্র পাচ বছর বয়সে সে এমন কিছু ভাবতে পারে কেউ কি কল্পনা করতে পারে? রুপকথার গল্পে হলে না হয় মানা যেত। বাস্তবে এমন ঘোড়া! কিন্তু সে যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই সে এমন একটি ঘোড়া তৈরি করেই ছাড়বে এবং শুধু একটি নয় পরবর্তীতে দুনিয়ার সব শিশু কিশোর কিশোরীদের জন্য এমন টাট্টুঘোড়া তৈরি করবে বলে সে সিদ্ধান্ত নিলো। নাম দিলো পাওয়ারপনি।
মনজিডেলিস আবিস্কৃত সেই পাওয়ারপনিতে আইওএস সাপোর্ট করে! আছে একটি জুমি ইঞ্জিন! আর এটা আবিস্কারের পর তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। শিশু কিশোর কিশোরীদের মধ্যে তার আবিস্কৃত পাওয়ারপনি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। সে নিশ্চয়তা দিয়েছে এই টাট্টুঘোড়ায় যারা চড়বে তারা প্রত্যেকেই অনেক আনন্দ পাবে।
নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে থাকে মনজিডেলিস। সে পাওয়ারপনির আবিস্কারক এবং প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে শোর রোড এলিমেন্ট্রি স্কুলে সিক্সথ গ্রেডে পড়াশোনা করছে। ছোটবেলা থেকেই ঘোড়া পছন্দ করতো এবং স্বপ্ন দেখতো একদিন সে একটি ঘোড়ার মালিক হবে। কিন্তু সে যেখানে থাকতো সেখানে ঘোড়া রাখার মত জায়গা ছিলো না। সুতরাং বাবা মা তাকে ঘোড়া কিনে দিতে পারেনি। কিন্তু সে কখনো হাল ছাড়েনি। সে তার স্বপ্ন পূরণে সব সময় ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এক ক্রিসমাসে সে একটি খেলনা ঘোড়া এবং একটি হভারবোর্ড উপহার পেয়েছিল। সে ভাবলো আচ্ছা যদি ঘোড়াটাকে হভারবোর্ডের উপর বসিয়ে দেই তাহলে কেমন হয়? তাহলেইতো একই সাথে দুটোতেই চড়া হবে আর তার ইচ্ছেও পূরণ হবে। আর সেই সময়েই তার মাথায় আইডিয়া আসলো ব্যাটারি চালিত ঘোড়া তৈরি করবে যেন যখন খুশি, যেখানে খুশি সে চড়তে পারবে। আর এ কাজে তাকে তার বাবা খুবই সহযোগিতা করেছে। যখন সে তার আইডিয়া বাবার সাথে শেয়ার করলো বাবা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো।তারপর তিনি তাকে সবরকম সহযোগিতা করলেন। একসময় বাবা কঠোর পরিশ্রম করতেন। কিন্তু মনজিডেলিসের আইডিয়াটা শেয়ার করার পর দুজনে মিলে যখন সত্যি সত্যিই পাওয়ারপনি তৈরি করে ট্রায়াল দিয়ে সফল হলেন এবং বাজারে বিক্রি করে দারুণ সাড়া পেলেন তখন থেকে তাদের ভাগ্যই বদলে গেলো। মনজিডেলিস তাই নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবতী মেয়ে মনে করে।
মনজিডেলিস নিজে যেহেতু ছোট তাই সে ছোটদের বিষয়টা মাথায় রেখেই তার ব্রান্ডের একটি সুন্দর নাম খুঁজতে শুরু করলো। অনেক নামের ভীড়ে শেষে পাওয়ারপনি নামটা তার বেশি পছন্দ হলো।তার বন্ধুরা তার এই আবিস্কারে ভীষণ এক্সাইটেড ছিলো। যখনই সে নতুন একটি পাওয়ারপনি তৈরি করে তার ট্রায়াল দিয়েছে তখনই বন্ধুরা উৎসাহ নিয়ে সেটা দেখেছে। উপভোগ করেছে। একবার এক সাক্ষাৎকারে মনজিডেলিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তুমি এই পাওয়ারপনি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন জিনিসটি শিখেছ? সে তখন বলেছিল ”ছোট বলে কাউকে অবজ্ঞা করা যাবে না। এবং ছোটদের কল্পনায় যা আসে সেটিকেও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সেই আইডিয়াও বাস্তব জীবনে নিয়ে আসা সম্ভব যা আমি করে দেখিয়েছি। বিশ্বাস,আস্থা,সহযোগিতা আর গ্রুপওয়ার্ক করতে পারলে অনেক কিছুই করা সম্ভব যা প্রাথমিক ভাবে অসম্ভব মনে হতে পারে।”
তার প্রতিষ্ঠানে রয়েছে স্পেশাল ডিজাইনার,ইঞ্জিনিয়ার,ইলেক্ট্রিশিয়ান। আর প্রতিটি কাজই সে নিজে তদারকি করে থাকে। ডিজাইনার যখন ডিজাইন করে তখন সে নিজে সেটা দেখে এবং জাস্টিফাই করে যে সেই ডিজাইনটি তার গ্রাহকশ্রেণীর পছন্দ হবে কি না। যদি কিছু মডিফাই করার দরকার হয় তাহলে সে সেভাবেই ইন্সট্রাকশন দেয়। মনজিডেলিসের মতে নিজের মত করে একটি ব্যবসা দাড় করানো খুবই কঠিন বিষয়। তবে যদি নিজের আইডিয়ার উপর নিজের প্রবল বিশ্বাস থাকে,যথাযথ পরিকল্পনা থাকে আর লেগে থাকার মত মানসিকতা থাকে তাহলে যে কেউ সেই প্রজেক্ট সফল করার পথ নিজেই খুঁজে নিতে পারবে। আর এই পথপরিক্রমায় যতই বাঁধা আসুকনা কেন, সেগুলো অনায়াসেই পার করা সম্ভব হবে।
ক্রিসমাসে পাওয়া দুটো উপহার আর নিজের একটি স্বপ্ন থেকে কিশোরী মনজিডেলিস সফল উদ্যোক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে উদ্যোক্তা হবো বা কিছু করবো এমন ধারণা নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। মিয়া মনজিডেলিসের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষাই পেতে পারি যে শুরু করার কোনো বয়স সীমা থাকে না আর শুরু করার পর লেগে থাকলে একদিন না একদিন সফলতা আসবেই। হাল ছাড়া যাবে না।
লেখক: জাজাফী
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩