শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই অর্থাৎ সেই শৈশব থেকেই গুরুজনদের কাছ থেকেই শুনে আসছি, “বই মানুষের পরম বন্ধু”। এই নীতি বাক্য মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যারা বইপ্রেমিকরা হারিয়ে যেতে চায় বইয়ের বিশাল সাম্রাজ্যে।বইয়ের সাথে এমন বন্ধুত্ব গড়েছেন যারা তারা চাইলে ডুবে যেতে পারেন বেঙ্গল বই এ থাকা হাজারো বইয়ের সমারোহে।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে এবং বই প্রেমীদের জন্য নান্দনিক একটি আড্ডার জায়গা তৈরি করার জন্যই বেঙ্গল ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছে বেঙ্গল বই। শুধুই বইয়ের দোকান নয় এই মনোভাব নিয়ে ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ার ডি-ব্লকের দুইটি ভবনে গড়ে তোলা হয় বেঙ্গল বই। এটি একটি বই বিপণি বিতান হলেও একে শুধুই একটি বইয়ের দোকান বলা যাবেনা। এখানে বই কেনা ও পড়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি রয়েছে নানামুখী আয়োজন।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, ‘শুধু ভালো একটা বইয়ের দোকান করাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। সমাজের যে নানা অবক্ষয় নিয়ে আমরা চিন্তিত, সেটা নিয়ে একটা কাজ করতে চেয়েছিলাম। ঢাকা শহরে খুব বেশি বইয়ের বিপনি নেই, যেখানে গিয়ে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া যাবে। সবকিছুর সমাধান হয়তো বইয়ে নয়, কিন্তু মনন-রুচি তৈরির আবহ তৈরি করতে চেয়েছিলাম।’
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু বলেন, ‘দেশজ সংস্কৃতি চর্চার নানামুখী কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন জনরুচি, জীবন ও মননে মাত্রা সঞ্চারে প্রয়াসী। এই কর্মপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় রুচিশীল পাঠক তৈরির লক্ষ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মিলন-আবহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল বই।’
বাংলাদেশের ২৫টি ও ভারতে ১৫টি প্রকাশনার বই পাওয়া যাবে এখানে। গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে মিলবে শিল্পকলা, সাহিত্য, স্থাপত্যবিষয়ক বইও।বাংলাদেশের প্রকাশিত যে কোনো বই ২০ শতাংশ ছাড়ে কিনতে পারবেন। তবে ভারতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে বইয়ের মূল্যের দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হবে।
বইয়ের পাশাপাশি থাকছে লেখাপড়ায় সহায়ক নানা সামগ্রী। বেঙ্গল বই-এ নিয়মিত পাঠচক্র, কবিতা পাঠের আসর, নতুন লেখা ও লেখকের সঙ্গে পরিচিতিমূলক সভা, প্রকাশনা উৎসব, চিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজন থাকে বলেও জানিয়েছেন আয়োজকরা। রুচিশীল পাঠক তৈরির লক্ষ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মিলন-আবহে তৈরি পরিবেশে পাঠকেরা বই না কিনেও পড়তে পারে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। প্রায় ৪০ হাজার বই এর সংগ্রহশালা থেকে পাঠক তার পছন্দ অনুযায়ী বই পড়তে পারে।
বেঙ্গল বই-এ ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবনের দোতলা ও তিনতলা জুড়ে রয়েছে দেশি-বিদেশি বই এর কালেকশন। অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ারে পুরো জায়গা ঘুরে নিজের পছন্দমাফিক বই কিনতে পারবেন। নিচতলায় সব শ্রেণির পাঠকের জন্য রয়েছে পুরনো বই ও ম্যাগাজিন, সঙ্গে চা-শিঙ্গাড়ার আয়োজন। সেখানে তরুণ-বৃদ্ধ সকলের জন্যই রয়েছে বসবার স্থান, রয়েছে বই বিনিময়ের সুযোগ। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বৈঠকখানা’।
ভবনের দোতালায় রয়েছে বই কেনার সুযোগ তার সাথে বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে। এছাড়াও উন্মুক্ত বারান্দায় গাছের ছায়াতলে বসে বই পড়ার ব্যবস্থাও আছে এখানে। পছন্দ হলে কোনো বই নিয়েও যাওয়া যাবে বইয়ের হাট থেকে, সেটি ফেরতও দিতে হবে না। তবে সেক্ষেত্রে আপনার সংগ্রহে থাকা দুটি পুরনো বই দিয়ে যেতে হবে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ও কমিউনিকেশন বিভাগের উপ ব্যবস্থাপক এ আর এম আখতার হোসেন জানান, ‘বই দেয়া-নেয়ার চমৎকার প্রথাকে উৎসাহিত করতেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।পাশাপাশি লেখক ও পাঠকদের নিয়ে আমরা নিয়মিতভাবে প্রতিমাসে অন্তত একটি “আলাপে বিস্তার” শিরোনামে মিলন মেলার আয়োজন করে থাকি।’
ভবনের তৃতীয় তলাটা শিশুদের জন্য। এর নাম দেওয়া হয়েছে “আকাশকুসুম”। শিশুরা এখানে বসে বই পড়তে পারবে, আঁকতে পারবে, খেলতেও পারবে। এছাড়াও রয়েছে শিশুদের গল্প বলা, ছড়া-আবৃত্তি, সুন্দর লেখা শেখানোর ব্যবস্থা। মাঝে মাঝে এখানে শিশুদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। এছাড়াও এখানে রং তুলিসহ লেখা-পড়ার বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া যায়। ছাদে রয়েছে মন জুড়ানো এক চিলেকোঠা চাইলে সেখানেও বই পড়া যাবে।
বিতণীর পরিবেশকে আরো নান্দনিক করে তুলতে দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন শিল্পী চিত্রকর্ম। আছে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের একটি ভাস্কর্য। এখানে নিয়মিত পাঠচক্র, কবিতা পাঠের আসর, নতুন লেখা ও লেখকের সঙ্গে পরিচিতিমূলক সভা, প্রকাশনা উৎসব, চিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একটু সবুজও দেখা মিলবে ভবনের ফাঁক গলে। এখানে বয়স্কদের জন্য আছে আলাদা বাগান, সেখানে তাঁরা নিরিবিলি বসে গল্প করতে পারবে।
এছাড়া সরকারি ছুটির দিনে বাগানের উঠানে বই পড়ার পাশাপাশি থাকছে সকালের নাস্তার ব্যবস্থা। লুচি, খিচুরির মতো খাবারের মাধ্যমে বাঙালি ঐতিহ্যের ছোঁয়া নিতে পারবেন অতিথিরা। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ‘আনিসুল হক’ বেঙ্গল বই সম্পর্ক তার ফেসবুকে প্রোফাইলে লিখেছেন, ‘বাড়ির কাছে বেঙ্গল বই। বেঙ্গল বই এ প্রতিদিন প্রায় পাঁচ’শ দর্শনার্থী আসেন। আর ছুটির দিন হলে পাঠক-দর্শনার্থীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়।
প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত যে কেউ এখানে এসে বই পড়তে পারবে। সেক্ষেত্রে কোন ফি দেওয়া বা রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন নেই। তাই সময় গুছিয়ে আপনিও এক কাপ চায় ও বই এর সাথে আড্ডা দিতে ঘুরে আসুন বেঙ্গল বই তে।
Comments are closed.