চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর কুল ঘেষে অপরুপ এক গ্রাম। গ্রামের নাম বালিয়াডাঙ্গা। সেখানে জন্ম হয়েছিল আমাদের বন্ধু জুবায়ের আহমেদ। হ্যাঁ আজ বলব সংগ্রামী এক বন্ধু জুবায়েরের কথা। যার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সংগ্রামের গল্প লুকিয়ে আছে। ওর বাবা ছিলেন একজন কৃষক , পাশাপাশি বাড়ির পাশে একটি মসজিদে নামাজ পড়াতেন। মা ছিল গৃহিনী। জুবায়ের ছিল যথেষ্ট মেধাবী। যা শুনত নিজের কানে তুলে নিত। ছোটবেলা থেকেই তার বাংলা সংস্কৃতির প্রতি ছিল অগাধ ভালবাসা।২০০৫ সালে জুবায়ের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ২০০৭ সালে ও যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখন বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নব্যাপী সকল স্কুলগুলোকে নিয়ে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছোট্ট জুবায়ের সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
গান, কুরআন তেলাওয়াত, কবিতা আবৃত্তি, একক অভিনয় প্রত্যেকটা ইভেন্টেই জুবায়ের প্রথম স্থান অধিকার করে শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগির স্থান পায়। সবাই অনেক খুশি হয়। কিন্তু রক্ষনশীল পরিবার হওয়াই ওর বাবা সেটা মেনে নিতে পারেননি।তাকে মারধর করা হয় এমনকি তার পুরস্কারগুলো ফেলে দেয়া হয়। ওর মা ছিল ওর পাশে। যত্ন করে ছেলের পাওয়া পুরস্কারগুলা তুলে রেখেছিল। ওকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। জুবায়ের-এর সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় ওর নতুন জীবন। ও যখন মাদরাসায় ক্লাশ ফাইভে তখন ও মঞ্চে তাফসির করত। ছোট একটা বাচ্চা তাফসীর করছে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত। কিন্তু জুবায়ের জীবনের কোন মানে খুজে পাচ্ছিলনা। ওর মন চাইতো মন খুলে গান গাইতে, অভিনয় করতে, স্বাধীনভাবে চলতে। কিন্তু পরিবারের নিষেধাজ্ঞার জন্য সে কিছুই করতে পারতোনা। ছোট মানুষ, কতটুকু বুদ্ধি হয়েছে তার। তবুও সে লুকিয়ে লুকিয়ে টেলিভিশন দেখত। মনের মধ্যে সুপ্ত এক বাসনা সেও টিভিতে অভিনয় করবে, গান গাইবে।
এভাবে জুবায়ের মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এবার জুবায়ের কিছুটা বড় হয়ে গেছে। জুবায়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবার থেমে গেলে চলবে না। কিছু একটা করতে হয়। জুবায়ের জিদ করে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়৷ তখন জুবায়ের অনেকটা স্বাধীন। সেই সময় পরিবারের অজান্তে ও একটা কমিউনিটি রেডিওতে যোগ দেয়। সেখানে ও নিয়মিত উপস্থাপনা শুরু করে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে। স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। দেখতে দেখতে জুবায়ের ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে। এবার জুবায়ের চায় ও ঢাকা যাবে, কিন্তু তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা নেই ওকে ঢাকায় রেখে পড়ানোর, তাই তার ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত তার পরিবার মেনে নেয় না। জুবায়ের তবুও দমে যায়নি। তার বিশ্বাস সে ঢাকায় গিয়ে কিছু একটা ঠিক জোগাড় করে ফেলবে। জুবায়ের ঢাকা চলে আসে। হাতে মাত্র কিছু টাকা।
অজানা অচেনা এই শহর। বড়ই অদ্ভুত। সারাদিন কোন বাসা খুঁজে না পেয়ে প্রথম রাতটা ওর ফুটপাতেই কাটে৷ পরে পিদিম থিয়েটারের পরিচালক আকতার হোসাইনের সহযোগিতায় জুবায়ের কিছুদিনের জন্য থিয়েটারে গিয়ে উঠে। তারপর অনার্সে ভর্তি হয় জুবায়ের। থিয়েটার ও শুরু করে। লক্ষ্য একটাই, ভাল একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে দেখা। ব্যাপারটা ওর জন্য এত সহজ ছিল না। আজব এই শহরে টিকে থাকার জন্য প্রতিটি মুহুর্তে জীবনের সাথে লড়াই করতে হয়েছে তাকে। হঠাৎ কিছুদিন পর ওর স্বপ্ন বাস্তবে এসে ধরা দেয়। একটা টিভি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ হয়ে যায় ওর। স্বপ্নটাকে হাতের মুঠোয় ধরতে পেরে ও যে কি খুশি হয়েছিল। যে টেলিভিশন দেখার জন্য ও কত বকুনি কত মার খেয়েছে আজ টেলিভিশনে তাকে দেখা যাবে। জুবায়ের একের পর এক কাজ করতে থাকে। এক বছরে জুবায়ের ৫ টা একক নাটক ১ টি ধারাবাহিক নাটক, একটি ওয়েবসিরিজ, ৩ টি শর্টফিল্ম ও দুইটি বিজ্ঞাপনে কাজ করছে। ভবিষ্যতে নিজেকে অনেক বড় অভিনেতা হিসেবে নিজেকে দেখতে চায় জুবায়ের। জুবায়েরকে আমাদের অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। ওর এই পথচলা যেন থেমে না যায়। সবাইকে ছাড়িয়ে সে খ্যাতিমান হয়ে উঠুক।পা থাকুক মাটিতে।ছোটদেরবন্ধুর পক্ষ থেকে জুবায়েরকে অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। ওর এই সংগ্রামী গল্প থেকে সবাই শিক্ষা নিতে পারবে যে কোন অবস্থাতেই হার মানা চলবে না। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই।
Comments are closed.