জায়ান ও জারা যমজ দুই ভাইবোন। বাবা – মায়ের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ক্যালিফোর্নিয়া শহরে ওদের বসবাস। ১৮ বছর আগে পিএইচডির উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান জায়ান জারার বাবা মা। তারপর এখানেই চাকরি তাই এখানেই বসবাস শুরু করেন তারা। জায়ান জারার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবই এখানে। ওদের বন্ধু – বান্ধব ও খুব বেশি। ওদের ভালো আচরণ, পড়াশোনা, খেলাধূলায় সফলতার জন্য সবাই ওদের খুব পছন্দ করে। বিদেশে থাকলেও দেশের প্রতি ওদের ভালোবাসা সীমাহীন। এর পিছনে ওদের বাবা – মায়ের রয়েছে অসীম ভূমিকা।
বাবা – মা সবসময় জায়ান – জারার সাথে বাংলায় কথা বলেন। জায়ান জারা ও ওদের বন্ধুদের সাথে দেশের গল্প বলে। ভাষা – আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, সংস্কৃতি এসব নিয়েই কথা বলে। ওদের বন্ধুরা ও বিস্ময়ভরা চোখে মুগ্ধ হয়ে শুনে সেসব কথা। দেখতে দেখতে শীত চলে এলো। ডিসেম্বরের শীতে ওরা স্কুলে খুব লম্বা একটা বন্ধ পায়। এসময় প্রতিবারই ওরা বাবা – মায়ের সাথে বাংলাদেশে আসে । কিন্তু এবার বাবা মা ছুটি পায়নি। তাই ওদের খুব মন খারাপ। কিন্তু দেশে তো ওদের যেতেই হবে। তাই বাবা মাকে ছুটি নিতে বাধ্য করে ওরা। বাবা মা ও ছুটি নিয়ে নেন। দেশকে তো তারা ও খুব বেশি ভালোবাসেন! হ্যারি, হারমানি, রন ওদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। জায়ান জারার কাছে বাংলাদেশের গল্প শুনে ওদের ও এ দেশের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। তাই ওরা বাংলাদেশে আসতে চাইলে জায়ান জারা সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
লং জার্নির পর বাবা-মা জায়ান- জারা ও তারা বন্ধুরা বাংলাদেশে এসে পৌঁছাল। ওদের মামা জাফর সাহেব এয়ারপোর্ট থেকে ওদের নিতে এসেছে। ইংরেজীতে বি এ পাশ করা সত্বে ও মাটির টানে এখনো গ্রামেই পড়ে আছেন তিনি। গ্রামের চেয়ারম্যান তিনি পাশাপাশি কৃষিকাজ ও করেন। গ্রামে বেশ নামডাক তার। কাগজপত্রের কাজের জন্য বাবা চাচার বাসায় ঢাকা থেকে গেলেন। জায়ান জারা ও তার বন্ধুরা মামার সাথে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে গ্রামের উদ্দেশ্যে মামার সাথে রওনা হলো। ট্রেন ছাড়ার পর ওরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল বাংলার সবুজ প্রকৃতি। সব শুধু সবুজ আর সবুজ। দেখলেই চোখ দুটি জুড়িয়ে যায়। আরো এক লম্বা যাত্রার পর ওরা গ্রামে এসে পৌঁছাল। সোনালি ফসল, বড় বড় গাছ, সবুজ দিঘির জলে ওরা আরো বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। হ্যারি, রন, হারমানি শুধুই অবাক হচ্ছে। মনে হয় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। সেদিন আর গ্রামের কিছু দেখা হলো না ওদের।
রাতের খাবার খেয়ে জায়ান জারার মামাতো দুই বোন সিন আর জীমের সাথে কথা বলে ঘুমিয়ে গেল ওরা। খুব ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল ওদের। চারিদিকে আবছা আলো। কুয়াশার জন্য বেশি দূর দেখা যায় না। আর প্রচুর শীত। ঘর থেকে বের হয়ে হারমানি বলে উঠল, “ইটস জাস্ট বিউটিফুল! রিয়েলি জাস্ট ওয়াও! ” বাকিদের ও ডেকে আনল ও। ওদের অবাক হওয়া যেন শেষ হচ্ছে না। সিন আর জীমের ডাকে ওদের হুশ ফিরল। “চলো ঘাটে যেয়ে দাঁত মেজে আসি। পারে নাস্তা খাবে “, সিন বলল। ওরা সবাই সিন জীমের সাথে ব্রাশ নিয়ে ঘাটে গেলো। খুব ঠান্ডা পুকুরের পানি। একদম কাপনি তুলে দেয়। নাস্তা খেতে এসে দেখল সে এক বিরাট আয়োজন। কত পিঠা।
ঝুনা নারকেল আর খেজুর গুড়ের ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ চিতুই। আর আছে চোঙাপিঠা। বাঁশ লম্বা করে কেটে কলাপাতা পেচিয়ে বিন্নিচাল দিয়ে বাঁশ পুড়িয়ে দা দিয়ে কেঁটে বানানো হয় এ পিঠা। মামী রাধতে ভালোবাসেন। তার চেয়ে ও বেশি ভালোবাসেন খাওয়াতে। আমি ওদের প্লেটে একটার পর একটা দিয়েই যাচ্ছেন। খেতে খেতে ওদের অবস্থা কাহিল।খাওয়া শেষে মামা ওদের নিয়ে আবার হলেন গ্রাম দেখাতে। চারপাশে ফসলের মাঠ, সবজির ক্ষেত পুকুর খাল – বিল। কি অপরূপ সৌন্দর্য! হঠাৎ এক লোক খেজুর গাছ থেকে নেমে মামাকে সালাম দিল। -“কি মজিদ মিয়া খেজুরের রস নিচ্ছো?” মামা বললেন। -“জ্বি, চেয়ারম্যান সাহেব “। – ” তা আমাকে দাও দেখি দুই বোতল । ” বলার সাথে সাথেই মজিদ মিয়া মামাকে দুই বোতল খেঁজুরের রস দিয়ে দিলেন। অনেক জুড়াজুড়ির পর টাকা নিলেন মজিদ মিয়া। ওরা খুব মজা করে খেঁজুরের রস খেলো।
রন, হারমানি, হ্যারি বাংলায় কথা না বলতে পারলেও বাংলায় বুঝে। দুপুরে শোল মাছ মটরশুটির ঝোল, কাতল মাছ দিয়ে ফুলকপি, টমেটো, শীমের তরকারি দিয়ে কাতল মাছের ঝোল দিয়ে বিন্নিচালের ভাত খেলো। সে এক অপূর্ব স্বাদ! মুখে লেগে থাকার মতো। সন্ধ্যায় মামার সাথে বাজারে গেলো ওরা। জায়ান জারারা বসে আছে ছোট্ট একটা বেন্ঞ্চে। মামা শিক কাবাবের অর্ডার দিলেন। একটু পরেই মচমচে রুটির মাঝে শিককাবাব, কাটা পেঁয়াজ, কুচি কুচি করে কাটা মরিচ আর বিট লবণের মসলা মাখিয়ে চলে এলো ওদের হাতে। মচমচে রুটিতে কামড় দেওয়ার কচরমচর শব্দ হচ্ছে।
বাজারের এক জায়গায় ডিম বিক্রি হচ্ছে। মামা ছয়টা হাফ বয়েল ডিম অর্ডার করলেন সবার জন্য। মসলার মিশেলে নরম ডিমের স্বাদ অদ্ভূত মজা লাগল ওদের। পাশের দুধওয়ালা সবুজ কাচের গ্লাসে উপচে পড়া দুধ তুলে দিচ্ছেন ক্রেতাদের। শীতের রাতে ফু দিয়ে তৃপ্তি করে দুধ খাচ্ছে গ্রামের লোকজন। রাতে ওরা বিরোই চালের ভাতের সাথে গোল করে কাটা কচুর থোর, হাসের মাংস,খাসির মাথার মুড়িঘন্ট, চালতার আচার খেলো ওরা। জায়ান মামাকে বলে উঠল, “এইবার দেশে থেকে যে কয়টা সুখের স্মৃতি নিয়ে ফিরব, মামীর হাতের খাসির মুড়িঘন্ট একটা। ” বাইরে কুয়াশা পড়ছে। খাওয়া শেষে সবাই চাদর মুড়ি দিয়ে বসে গল্প করতে করতে সুখের অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আহা সুখ! শীতকালের সুখ!
লেখক:মাহজাবীন মম
দশম শ্রেণী
বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
Comments are closed.