বিভিন্ন সংগঠনে ভলান্টিয়ারিং করার সুবাদে নানান অভিজ্ঞতা যেমনি লাভ করা যায়।ঠিক তেমনি সুন্দর সুন্দর ঘটনারও সাক্ষী হওয়া যায়। বাড়ি ডুমছের গ্রামে!যেখানে সকাল সন্ধ্যা দুঃখিদের দেখা মেলে। আজ শোনাবো সেই গল্প।সুবিদা বঞ্চিত শিশুদের স্কুলের সাথে আছি বলে হরহামেশা শিশুদের সাথে মিশতে পারি।তবে এইবার যে শিশুদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছিল,বলতে গেলে সেই অভিজ্ঞতাটা সবারচেয়ে ভিন্ন।
আর ওই শিশুদের পেছনে লুকিয়ে আছে নানান রকমের গল্প।এক একটা গল্প যেন সিনেমার কল্প কাহিনীকেও হার মানায়।নাফ নদীর ওইপার থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কতৃক নির্যাতিত হয়ে রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠীরা আশ্রয় নিয়েছে এইপারে।রোহিঙ্গাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আবার শিশু।যারা বহু কষ্টে বড়দের সাথে এসেছে এই দেশে।এই শিশুরাই আসার পথে তাদের মধ্যে কেউ হারিয়েছে বাবা কিংবা মা কে।আবার কেউ হারিয়েছে পুরো পরিবারটিকেই।আবার কেউ চিরতরের জন্য হয়ে গেছে পঙ্গু!
কিছুদিন আগে আমার একটা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করার সুযোগ হয়েছিল।ভলান্টিয়ারিং করার সুবাদে একটা সরকারি সংস্থার অধীনে গিয়েছিলাম উকিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।আমাদের কাজ ছিল আসন্ন দুর্যোগ সম্পর্কে তাদের সচেতন করা এবং দুর্যোগ থেকে নিজেদের কিভাবে রক্ষা করবে তা শেখানো।সকাল আটটার দিকে সংস্থার গাড়ি করে রওনা দিলাম ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।মনে মনে একটা নতুন রোমাঞ্চ অনুভূত হতে লাগল।মনোমুগ্ধকর মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে যখন গাড়ি চলতে লাগল তখন সে রোমাঞ্চটা আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠল।না!এর আগে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে কোথাও যায়নি তেমনটা না।কিন্তু এইবারের যাওয়াটা একটু অন্যরকম।
চারিদিকে মিষ্টি রোদের ঝিলিক,একপাশে পাহাড় আর এক পাশে সমুদ্রের নীল জলরাশি এ যেন অপূর্ব এক প্রকৃতি।পাহাড়ের পাদদেশকে হাতছানি দিয়ে ঢেউয়ের গর্জনের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের গাড়ি আঁকাবাঁকা মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে চলতে লাগল বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।ঘন্টা দুয়েক পর যখন গাড়ি বালুখালী প্রবেশ করল,তখন উকি দিয়ে কিছু দূর থেকে দেখতে পেলাম অসংখ্য ক্যাম্প।গাড়ি ক্যাম্পে পৌঁছাতেই কতগুলো শিশু আমাদের কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল।গাড়ি থেকে নেমে চলে গেলাম সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে তাদের অস্থায়ী অফিসে।
অফিসে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল,আলাপ আলোচনা হল আমাদের করণীয় সম্পর্কে।ও হ্যাঁ আমি কিন্তু যাওয়ার সময় মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি বেশিরভাগ সময়ই কাটাবো রোহিঙ্গা শিশুদের সাথে।আর এই জন্য পকেটে করে কিছু চকোলেটও নিয়ে গেলাম।আর সঙ্গে একটা কলম ও ডায়েরি।আমি শিশুদের সাথে কথা বলার জন্য এক কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতিটাও নিয়ে রেখেছি।আমাদের কর্মশালা শুরু হতে আরও ঘন্টা দুয়েক লাগবে।এইফাঁকে আমি ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রোহিঙ্গা শিশুদের মুখ থেকে কিছু শুনব বলে।এর জন্য আমার বেশি বেগ পেতে হলোনা।
কাছেই কিছু রোহিঙ্গা শিশুরা খেলছে।ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে তাদের কাছে গেলাম।ও হ্যাঁ এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো,আপনি যদি কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষা না জানেন তাহলে রোহিঙ্গাদের কোনো কথাই আপনি বুঝবেন না।যেহেতু আমি কক্সবাজারের ঐ কারণে তাদের সাথে মিশতে বা কথা বলতে আমার কোনো সমস্যাই হলোনা।বরং তাদের সাথে মজাই হলো।তাদের কাছে গিয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন আছো তোমরা।সাথে সাথে সবাই ভাব গম্ভীর হয়ে হাঁ করে কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।বোধ হয় তারা মনে মনে ভাবতে লাগল এই অগান্তুকটি আবার কে!আমিও আমার কৌশলটা পাল্টিয়ে,কৌশল চকোলেট শুরু করে দিলাম।
পকেট থেকে চকোলেটগুলো যেই না বের করতে গেলাম!অমনি কাড়াকাড়ি পড়ে গেল।এইবার সবাই আমার গা ঘেষাঘেষি শুরু করে দিল।আমিও বাচ্চাটি হয়ে তাদের সাথে বসে পড়লাম মাটিতে।তখন সবার উদ্দেশ্যে বললাম তোমরা কি স্কুলে যাও?সবার কাছ থেকে উত্তর পেলাম না!আবার প্রশ্নটা করলাম কিন্তু অন্যভাবে।কারণ তারা স্কুল কি তা জানেনা।এইবার কয়েকজনের কাছ থেকে উত্তর আসলো।কেউ বললো ক্যাম্পের মকতবে যায়।আবার কেউ বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত স্কুলে।
আমার আশেপাশে দশ বারোজন যারা ছিল তাদের সবার নাম জিজ্ঞাসা করলাম।এক একজন যখন তাদের নামগুলো বলছিল আমাকে তখন তাদের নামগুলো বলার মধ্যে অদ্ভুত এক সুন্দর্য দেখতে পেলাম।সবাই তাদের পুরো নামটি খুবই সুন্দরভাবে বলল।অর্থাৎ কেউ তাদের ডাক নাম কিংবা অর্ধেক নাম বললনা।আমি মুগ্ধ যেমনি হয়েছি,ঠিক তেমনি অবাকও হলাম বটে।মনে মনে চিন্তা হলো এরা মিয়ানমারের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সত্ত্বেও কি করে নামটি সুন্দরভাবে বলা শেখলো।
হাতে সময় কম।তাছাড়া এতগুলো শিশুর এইদেশে আসার পেছনের কাহিনী আমার পক্ষে শুনা সম্ভব না।তাই বলে আমি বসে ছিলাম না।আমি দু-এক জনের কাজ থেকে জিজ্ঞাসা করলাম তাদের পেছনের গল্প।ইতিমধ্যে সংস্থার এক কর্মকর্তার ফোন আসল।আমি তাদেরকে বলে গেলাম তোমরা এইখানে বসো,আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসতেছি।সংস্থার নির্ধারিত একটা ক্যাম্পে গিয়ে দেখি অনেক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ এসেছে।
আমাদের ভলান্টিয়ার টিমের সদস্যরা ও সংস্থার কর্মকর্তারা তাদের সাথে কথোপকথন শুরু করে দিয়েছে।তাদের সাথে আমিও মিনিট চল্লিশেক ব্যয় করলাম।কিন্তু আমার মন পড়ে রইল ঐ বাচ্চাদের কাছে।একটু ফাঁক পেয়েই দিলাম ছুট তাদের কাছে।ভেবেছিলাম চলে যাবে,কিন্তু তারা দিব্যি খেলেই যাচ্ছে।অবশ্য ওরা নিজস্ব গন্ডির বাইরে বেরুই না।
লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে সবার সাথে খেলছিল এগারো কি বারো বছরের ছেলটি,কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলাম।বললাম তোমার নাম কি?ছেলেটি খুবই সুন্দর করে দুই হাত বগলে ঢুকিয়ে বলল মোঃ খলিল।
জিজ্ঞাসা করলাম তোমরা ভাই বোন কয় জন আর মিয়ানমারে তোমার বাড়ি কোথায় ?খলিল বলে যায়,আমি সহ আটজন।বার্মার সেনারা আমার বড় দুই ভাইকে কোপিয়ে মেরেছে।এক বোনকে কোথায় যেন তুলে নিয়ে যায়!কিন্তু আর ফেরেনি।এখন আমরা চার ভাই ও এক বোন।মিয়ানমারে আমার আর ওর(আরেক জনকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে) বাড়ি ডুমছের গ্রামে।খলিলকে বললাম এখানে কিভাবে এসেছ?খলিল বলে বার্মার সেনারা হঠাৎ একদিন বিকেলে গ্রামে ঢুকে পাড়ার সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।গরু,ছাগল,কবুতর,ধানের ড্রাম সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে।সেনারা এলোপাতাড়ি কোপানো ও গুলি ছুড়তে থাকে।তখন আমরা মা বাবার সাথে গ্রামের আরও অনেকে জঙ্গলে গিয়ে লুকোয়।
পরদিন আমরা গ্রামের আরও অনেকের সাথে এখানে চলে আসি।বললাম আসার পথে কি কি খেয়েছো আর নাফ নদীটা কিভাবে পারি দিয়েছো?খলিল উত্তর দেয় আমাদের সাথে আরও অনেকে ছিল,তাদের অনেকের কাছে কিছু খাবারও ছিল।তখন আমরা সবাই তা ভাগ করে খেতাম।আর খাবার যখন ছিলনা তখন জঙ্গলে যে ফলই পেয়েছি তা সবাই ভাগ করে খেয়েছি,তবে অনেক সময় না খেয়েই থেকেছি।নাফ নদীর পাড়ে যখন আসলাম তখন সবার মনে একটু পানি(স্বস্তি) আসে।তারপর এক মাঝির(গ্রাম্য মাতব্বর) মাধ্যমে সবাই একটা বোট ঠিক করে এখানে চলে আসি।বললাম ওখানে কি পড়াশুনার জন্য মকতবে যেতে?খলিল বলে হ্যাঁ গ্রামের একটা মকতবে যেতাম।
আর এখানে কি স্কুলে যাও জিজ্ঞাসা করতেই,ইউনিসেফ পরিচালিত একটা স্কুল ক্যাম্পের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল এখন ওখানে যায়।আমার মনে কৌতূহল জাগে আরও অনেক কিছু জানার,কিন্তু সময়টা না বড্ড বেপরোয়া!খালি ছুটতেই জানে।
তবে যে কয়জনের সাথে কথা বললাম,তাদের কথাগুলো শুনে এইটুকু বুঝতে পারলাম যে তাদের পেছনের গল্পগুলো মোটুমুটি এক।তাদের ও সুন্দর একটি গ্রাম ছিল।যেখানে সূর্য আলো দিত,বায়ু বয়তো,ফুলেরা ফুটতো,প্রজাপতিরা উড়তো,পাখিরা ডাকতো,আর খলিলরা সবাই দস্যি ছেলের মতো দাপাদাপি করে বেড়াতো।কিন্তু আজ সব শুধুই স্মৃতি।নিয়তির নির্মম পরিহাসই বলেন কিংবা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা।যেখানে বেঁচে থাকা দায়,সেখানে কিসের এতো আমোদ পূর্তি।যার কারণে তারা আজ প্রাণ বাঁচাতে এইদেশে।
পুব দিগন্তের সুয্যি পশ্চিমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।বাতাসও তার নিজের গতিপথ বদলে নিয়েছে।আশেপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু ক্যাম্প আর ক্যাম্প।খলিলরা যে যার ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে।হয়তো কোন একদিন মিয়ানমার সরকার এই রোহিঙ্গা শিশুদের বুকে টেনে নিয়ে বলবে তোমরাই আমাদের আগামী।তোমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ।সুযোগ করে দেবে খলিলদের ভালো করে পড়াশুনা করার।কে জানে হয়তো কোন একদিন এই রোহিঙ্গা শিশুদের মাঝখান থেকে বারেক ওবামাই উঠে আসবে!যায়,এবার আমার ফিরতি গাড়ি ধরতে হবে।
যাওয়ার আগে যে সুন্দর উষ্ণ অনুভূতিটা ধরা দিয়েছিল মনে,সেটা নিমিষেই উদাও হয়ে গেল রোহিঙ্গা শিশুদের যন্ত্রণা দেখে।তবুও আশা রাখি মিয়ানমার সরকার হয়তো একদিন তার নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে।আশা রাখি রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী আনকোরা স্বপ্ন নিয়ে কোন একদিন হাজির হবে।বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি মোড় নিয়েছে নিজ গন্তব্যে।
লেখকঃ হিমু চন্দ্র শীল
কক্সবাজার সরকারী কলেজ।