কিছুদিন আগে এক টিভি চ্যানেলে দেখাচ্ছিল দশ কি এগারো বছরের এক শিশু নির্যাতনের মাত্রা সইতে না পেরে রাজধানীর ইস্কাটনের এক বাড়ির এগারো তলা ফ্ল্যাট থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে আসতে শুরু করল।এই দেশ শিশুদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়,পদে পদে ওরা নির্যাতিত হচ্ছে।একবার ভাবুন নির্যাতনের মাত্রা কি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে! শিশুটি এতবড় একটা ঝুঁকি নিয়েছে।তবে ভাগ্য ভালো আশেপাশের মানুষরা তা দেখতে পেয়ে ৯৯৯ নাম্বারে কল করে দেয়।আমাদের পুলিশ বাহিনীকেও এর কৃতিত্ব দিতে হয়।কারণ তারা তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে বড় একটা দূর্ঘটনারর হাত থেকে শিশুটিকে রক্ষা করে।এবং এরই সাথে সাথে নির্যাতনের সাথে জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করে শ্রীঘরে পাঠিয়েছে।
শিশুটিকে নামিয়ে আনার পর প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি করা হয় তখনতো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আরও ভয়ঙ্কর রকমের নির্যাতনের তথ্য।যা গা শিউরে উঠার মতো।শিশুটিকে কারেন্টের শক দিতো!ঠিকমতো খাবার দিতো না।বাড়ির গৃহকর্তা গৃহকর্তীতো নির্যাতন করত এর পাশাপাশি তাদের এক নিকট আত্মীয়ও।যে কিনা তাদের সাথে ফ্ল্যাটে থাকতো।আর হুমকি দিয়ে বলত নির্যাতনের কথা যদি বাইরে কিংবা তার মা বাবাকে বলে তাহলে তাকে মেরে ফেলবে।পরে সাংবাদিকরা যখন তার পিঠ উল্টালো তখনি সারা পিঠে দেখাগেল বিচিত্র সব নির্যাতনের সাদা সাদা দাগ।এমনকি মাথায়ও।পুলিশ যখন আসামীদের রিমান্ডে নিয়ে যায় তখন বোধ হয় পুলিশও আসামীদের ঐ রকম অত্যাচার করেনা।ক্ষুদে শরীরটার এক একটা দাগ যেন আকুতি জানিয়ে বলতে চায় এই দেশ শিশুদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়,আমাদের রক্ষা কর হায়েনাদের থেকে।আর ঐ দাগগুলো এটাও বহন করে যে এইদেশের লক্ষ শিশুরা এইভাবেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দেশ এখন বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত!চারিদিকেই বিশ্বকাপের উন্মাদনা।এই উন্মাদনাটা পত্রিকায়ও লেগেছে,যার কারণে এই শিশুটির নির্যাতন নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় কোনো প্রতিবেদন দেখলাম না।এতে খুবই মর্মাহত হয়েছি।আমাদের দেশের শিশুরা যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে তারা বেশির ভাগই পরিস্থিতির শিকার।তারা নিজের অনীহা সত্ত্বেও পরিবারের চাপে অন্যের বাসায় কাজ করতে বাধ্য হয়।প্রত্যেক শিশুরই নিজের কিছু অধিকার রয়েছে।আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিশুই নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।শিশুরা যদি বুঝতে পারত তাহলে কোনো শিশুই চাইত না তাদের এই সুন্দর শৈশবটা হারিয়ে ফেলতে।
‘শিশু’এই শব্দটি দুইটি অক্ষরের হলেও,শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে সহজ সরল অকৃত্রিম ভালোবাসা।প্রতিটি শিশুর মন যেন স্রষ্টার এক অপরুপ সৃষ্টি।থাকেনা কোন রাগ বা ক্ষোভ,কিংবা অপরের ক্ষতি করার মনমানসিকতা বা অপরের উন্নতিতে ঈর্ষা।।তারা শুধু জানে তাদের মিষ্টি আচার আচরণ দিয়ে বড়দের মুখে হাসি ফোটাতে।আমার কেমন জানি মনে হয়;স্রষ্টা তাদের এক অপূর্ব অদৃশ্য শক্তি দিয়েছেন।কারণ পৃথিবীতে একমাত্র শিশুরাই চোখের পলকে অপরিচিত জনদের ও আপন করে নিতে পারে।কথাটি এই কারণে বলছি।একদিন আমি চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে কক্সবাজার আসতেছি। বাসে আমার দুই সিট আগে এক দম্পত্তি বসেছিল একটা দু এক বছরের রাজপরীকে কোলে নিয়ে।রাজপরীটার চেহেরা যেমনি মিষ্টি,তেমনি তার ক্ষুদে দুষ্টুমি গুলোও মজার ছিল।পুরো তিন ঘণ্টার জার্নিটাতে বাস ভর্তি সব মানুষকে ঐ রাজপরীটা একাই মাতিয়ে রেখেছিল।শুধু মাতিয়ে না!তার দিকে সবার মনযোগ ও ধরে রেখেছিল।আর আমরাও তাকে নানান অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে তার সাথে মিষ্টি খেলায় মেতে উঠেছিলাম।এমনকি বাসের কয়েকজন লোক ঐ রাজপরীটার মিষ্টি দুষ্টুমিগুলো মোবাইলে বিডিও করে নিয়েছে,আবার কেউ তার ফটোও তুলে নিয়েছে।শিশুদের মন সত্যি তুলার মতো তুলতোলে।
বিশ্বে অনেক কোটি শিশু রয়েছে।তাদের মধ্যে কেউ তার সুন্দর শৈশবটা উপভোগ করতে পারছে,আবার কেউ কাঁদে তুলে নিয়েছে পরিবারের দায়িত্বভার!আমাদের বাংলাদেশের কথা যদি বলি;তাহলে প্রতিদিন সকাল হলে আমরা দেখেতে পায় অনেকগুলো কোমল হাত নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে।যেখানে রয়েছে গাড়ির হেলপার থেকে শুরু করে ভাঙ্গারি কুঁড়ানি(যাদের আমরা টোকাই বলি)।ঠিক কিছুদিন আগে আমি ওরকম একজনের সাথে কথা বলেছিলাম।যে কিনা কাজ করত বিপজ্জনক গ্যাস সিলিন্ডার হাতে।তার নাম ছিল একারাম,বয়স এগারো কি বারো।পরিবারের দশ সদস্যদের মধ্যে সবার ছোট।তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম গ্যাস নিয়ে গাড়ির ওয়েল্ডিং এর কাজ করতে ভয় লাগে কিনা।সে বলেছিল ভয় লাগে,তবে প্রতিদিন করতে করতে আর লাগেনা।জিজ্ঞেস করেছিলাম স্কুলে যায় কিনা।বলেছিল,স্কুলে থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলাম পড়তে ভালো লাগে।কিন্তু মা বাবা চাইনা আমি পড়ি!তাই এই কাজে দিয়ে দিয়েছে।স্বপ্ন কি জিজ্ঞেস করলাম।বুঝল না!বললাম বড় হয়ে কি হতে চাও।অতৃপ্তির হাসি হেসে উত্তর দিল বড় হয়ে গাড়ির ম্যাকানিক হবো তারপর এই রকম একটা ওয়ার্কশপের দোকান দিব।তার ঐ হাসির রেখায় আমি দেখতে পেয়েছিলাম দেশের অসংখ্য এই রকম শিশুর ছাপ।
যদি তাদের পড়া লেখার সুযোগ থাকত তাহলে তারা কি এই রকমস্বপ্ন দেখত।কি অদ্ভুত স্বপ্ন তাইনা।আসলে এই স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হলেও,একারামদের কাছে এ এক বেঁচে তাকার উপায়।কোমল হৃদয়ে পরিবারকে সুখে রাখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।জানি এই রকম কয়েক লক্ষ্য একারাম এই দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।যাদের এই বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা,সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠার কথা তারা এই বয়সে যুক্ত হয়ে গেছে নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।কখনও রোবটের মতো খাঁটুনি কেটে,আবার কখনও উপোস থেকে অন্যের উদর ঠিকই ভর্তি করে যায় ঐ শিশুরা।তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে,এই রকম কাজ করতে গিয়ে কখনও লাঠির,কিংবা কখনও হাওয়ার নল পায়ুপথে ঢুকিয়ে কোমল শিশুদের হত্যা করা হয়।যখন তখন মিথ্যে অপবাদ গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বেরধড়ক পিটানো হয়।দিনশেষে নিরপরাধ অবলা মনুষ্য বাচ্চাগুলো বিগড়ে যায়।কারণ আপনি যদি তাদের ভালোবাসতে শেখান তাহলে এরা সারাজীবন ভালোবেসেই যাবে।তাদের মনটা খুবই মোলায়েম।
ইদানিং দেশে মানুষরূপি জানোয়ারদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।সুযোগ পেলেই হামলে উঠে শিশুদের উপর।অনেকে তাদের ক্ষুদে হাত দিয়ে ঘরের যাবতীয় কাজ করিয়ে নেয়।আবার অনেক নরপশু তাদের নির্লিপ্ত দৃষ্টি দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ লাভের জন্য শারিরীকভাবে শিশুদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।এমনকি ধর্ষিত হতে হচ্ছে কতগুলো কাপুরুষদের হাতে।আসলে যারা এইরকম জঘন্য কাজটি করে তার কি আদৌ মানুষ?আমারতো মনে হয় তারা মানুষ না।তারা আমার দৃষ্টিতে মানুষরূপী অমানুষ।এই অমানুষগুলোদের পাপের নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় নিষ্পাপ শিশুদের।
তবে আমার কেমন জানি মনে হয়,আমাদের দেশের শিশুদের চাইতে উন্নত দেশের শিশুরা খুবই ভালো আছে।কারণ ঐ সব দেশে শিশুদের দেখা যায়না গাড়ির হেলাপার হয়ে ডাকতে ‘এই নিউমার্কেট নিউমার্কেট।কিংবা ইয়া বড় কোন বস্তা মাথায় অথবা ঝালাইয়ের কাজে।কারণ তাদের ওখানে শিশুবান্ধব আইন আছে,আর আইনের যথাযত প্রয়োগও আছে।তবে ঐ সব দেশের শিশুদের ঠিকই দেখা যায় নতুন কিছু আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে।কথা হলো আমাদের দেশেও শিশুবান্ধব অনেক আইন আছে।কিন্তু অতি অনুতাপের বিষয় ঐ আইনগুলোর যথাযত ব্যবহার হয়না।তবে একটা কথা চিরন্তন সত্য যে শিশুর সবকিছুর সূতিকাগার হলো পরিবার।পরিবারই হলো শিশুদের প্রথম অলিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।শিশুর বিপদে আপদে পরিবারই একমাত্র ভরসাস্থল।কিন্তু আমাদের দেশের কিছু পরিবার শিশুদের পাশে না থেকে বরঞ্চ তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই দেশে শুধু যে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা হুমকিতে আছে তা কিন্তু নয়।মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা ও হুমকির মুখে।এর কারণ হলো ধূমপান ও মাদক।যখন তখন বেহায়াভাবে যত্রতত্র ধূমপান শিশুদেরকে স্বাভাবিক ভাবে কৌতূহলী করে তুলে।আর ধূমপানের বিষাক্ত নিকোটিন বাতাসে ভেসে ভেসে প্রবেশ করতেছে শিশুদের দেহে।ফলে অধূমপায়ী হয়েও কোমল শরীরে পাওয়া যাচ্ছে বিষাক্ত নিকোটিনের অস্তিত্ব।তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে কচি হৃদয়গুলো।আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের গুরুপূর্ণ শহরগুলোতে যে ছিন্নমূল শিশুরা আছে তারা মাদকের প্রতি ভয়াবহ রকমের আসক্ত।তারা মাদক হিসেবে গ্রহণ করতেছে সিসা থেকে শুরু করে জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত এক ধরনের আঠা।এই মাদকগুলো ঐ শিশুরা বেশি ব্যবহার করে,যারা ঐসব কারখানায় কাজ করে।অবশ্য এতে শিশুদের কোন দোষ নেই।কারণ কিছু কুচক্রী মহল এই সব মাদকগুলো সহজে শিশুদের হাতের নাগালে এনে দিচ্ছে।যার কারণে আজ আমাদের দেশের শিশুদের এই দুর্দশা।
আসলে এই দুর্দশাটা আজকের না এটা অনেকদিনের পুরনো।
আমরা কি পারিনা সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের রক্ষা করতে।
লেখকঃ হিমু চন্দ্র শীল
ছাত্র: কক্সবাজার সরকারী কলেজ।
Comments are closed.