“জীবনটা নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয়” এই কথাটা কে আগে শুধু কথার কথাই মনে হতো। কিন্তু এখন বুঝি, এটাই বাস্তবতা।ইচ্ছা করে না কাওকে দোষারোপ করতে। কারণ আঙুল উঠলে সেই আঙুল আমাদের দিকেও ঘুরবে। আমরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। তাই সবকিছু আমাদের কাছে সহজ। মাঝে মাঝে ছোটখাটো হতাশায় মনে হয়, জীবনটা এতো কঠিন কেন? বিতৃষ্ণা এসে পড়ে নিজের জীবনের প্রতি। কিন্তু যখন সত্যিকারের হতাশাগ্রস্থ জীবনের সাথে পরিচয় হয়, তখন বুঝি যে আমরা আসলে কতোখানি সুখে আছি। আমাদের শুধু একটাই সমস্যা, আমরা কৃতজ্ঞ হতে জানি না। আমাদের উচ্চ বিলাসিতা আমাদেরকে অনেক বেশিই অকৃতজ্ঞ করে তুলেছে।
দুটি মানুষের জীবন সম্পূর্ণ দুরকম কি করে হয়!
আমরা জন্ম হবার পর কতো আদরেই না বড় হয়েছি। স্কুলে গিয়েছি , প্রতিদিন ভরপেট খাবার পাওয়ার পর চকলেট, আইসক্রিম এর বায়না তো ছিলোই। রাতের বেলা আম্মু ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতো, কান্না করলে আব্বু কোলে নিয়ে কতো গল্প শোনাতো! ভুতের গল্প, পরীর গল্প, কুজো বুড়ির গল্প, গোল রুটির গল্প আরো কতো কি! খেতে না চাইলে আম্মু পেছন পেছন ঘুরতো আর লক্ষী সোনা, চাঁদের কণা বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াতো। আম্মু আব্বু শিখিয়েছে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। একটা পরিবারের ছায়ায় মায়ায় বড় হয়েছি।
আবার সেইসব শিশুর কথা যদি বলি, যারা আমাদের কাছে পথশিশু নামে অভিহিত। তারা যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তাদের পরিবারের মানুষরা (যদি থাকে) খুশি হয় না, বরং একটা বোঝা বাড়লো বলে বিরক্ত হয়। হাটা শেখায় উতসাহ দেওয়ার জন্য কেও হাততালি দেয় না। বরং নিজে থেকে হাটা শেখার পর পরই অন্ন খোজএ নামতে হয়। রাতে ঘুমানোর সময় হয়তো মা বাবাকে কাছেই পায় না। ঠিকমতো কথা শেখার আগে তারা ভিক্ষা করা শেখে। এইটুকু বাচ্চারা তখন থেকেই শেখে মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, চুরি করা, মানুষের কাছে হাত পাতা। বেঁচে থাকার জন্য এসব পন্থা তাদেরকে অবলম্বন করতে হয়। ওদেরকে তো কেও শিখিয়ে দেয় না, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। ওদের ছোট্ট বিবেক এসবের পার্থক্য করতে পারে না। ওরা সপ্ন দেখতে শেখে না। কারণ মানুষ সপ্ন দেখে ভবিষ্যৎ এর জন্য, কিন্তু ওরা তো বর্তমানে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে। ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবার উপায় কি ওদের আছে? জীবনটা ওদের কাছে রণক্ষেত্র।
প্রতিটা মুহূর্ত সংগ্রাম করতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। ওরা খেয়েছে কিনা, সেই খোঁজ কেও নেয় না। ওরা কান্না করলে কেও ঘুরেও তাকায় না। ওরা অসুস্থ হলে কেও ওষুধ কিনে দেয় না, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না। ওরা বেড়ে ওঠে নির্মমতার মাঝে। ভালোবাসার অর্থ তাদেরকে কেও জানতে দেয় না। তাই অন্যদের দূরবস্থায় ওদের মায়া হয় না। নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য ওরা অন্য মানুষের সাথে যেকোন ধরণের অবিচার করতে শিখে যায় এই ছোট্ট বেলা থেকে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে যখন শুনি ২.৫ – ৩ বছরের বাচ্চা মেয়েরা শারীরিক নির্যাতিত হয়, যখন দেখি এইটুকু বাচ্চারা গাঁজা বানাতে পারে, তখন ইচ্ছা করে না কাওকে দোষারোপ করতে। কারণ আঙুল উঠলে সেই আঙুল আমাদের দিকেও ঘুরবে। তখন জবাব দেওয়ার মতো কিছুই থাকবে না।এইসব বাচ্চাদের মন মারা যায় অনেক আগেই। ওরা শরীরকে বাচিয়ে রাখার জন্য মন পিষে মেরে ফেলে।
কখনো হঠাত আমার কোন ছাত্র(পথচারী স্কুলের) উধাও হয়ে যায়। আর কিছুদিন পরে তাকে যখন কালো ঠোট আর লাল চোখে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে দেখি তখন নিজেরই বিশ্বাস হয় না যে এই ছেলেটাকে কিছুদিন আগে আমি কোলে বসিয়ে অ আ ক খ লেখা শিখিয়েছি। স্কুল ছুটির পর গেট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে দৌড়ে এসে সে আমাকে জড়িয়ে ধরতো।
গাছে ফুল ফোটে। কিছু ফুল থাকে সখের ফুল। তারা সযতনে বড় হয় সুবাস ছড়ায়, সবার মন জয় করে। সেই ফুলগুলো সমাজের সোন্দর্য। সবাই সেই ফুলের প্রশংসা করে, সেগুলো পাওয়ার ইচ্ছা করে, কিন্তু কেও ছিঁড়ে ফেলার সাহস করে না। আবার কিছু ফুল জন্ম হয় চরম অযত্নে, তারা ফোটার আগেই ঝোরে পড়ে। কিছু ফুল ফোটে, বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা পোষণ করে, কিন্তু কেও এসে তাদেরকে ছিঁড়ে ফেলে, তারা আর বড় হতে পারে না। কারো জীবনে গ্রীষ্ম আসে মিষ্টি ফল হয়ে, কারো জীবনে আসে শুধুই কড়া রোদ হয়ে। বর্ষা এসে কারো তপ্ত হৃদয় কে শীতল করে দেয়। আর কান্না হয়ে কারো অশ্রু তে মিশে যায়। শীতে কেও মুগ্ধ হয়ে কুয়াশা উপভোগ করে, কেও একটুকরো কাপড়ের সন্ধান করে। বসন্ত কারো জীবনে এনে দেয় মধুরতা, আর কারো জীবনে বাড়ায় একাকীত্বতা।
ফুল ঝরে গেলে বাঁচানো সম্ভব না। কিন্তু আমরা যদি ফুলের কলিগুলোকে সংরক্ষণ করে বেঁচে থেকে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা দিতে পারি, খারাপ মানুষের হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে পারি, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি, তাহলে হয়তো আমাদের দেশটা আগাছার জঙ্গল না হয়ে ফুলের বাগান হবে, কোন ফুলকে বেচে থাকার জন্য লড়াই করতে হবে না।
লেখকঃ মালিহা নামলাহ
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ।
আরও পড়ুনঃ
- ক্ষুদে লেখক রাশিকের মিস্ট্রি অব দ্য সুপার ন্যাচারাল।
- শিহাব এবং টিটোনের সাহসীকতার গল্প।
- অনন্য যারিফ আকন্দ,গ্রহ নয় যেন একটি নক্ষত্রের নাম।
- বয়স ১৪ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
- রিয়া দিয়া ক্ষুদে মহাতারকা।
Comments are closed.