টুপুরের বয়স তখন মাত্র সতের দিন আর ওর এক মাত্র ভাই টিকলুর বয়স আড়াই বছর।এমন একটি দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আকাশের ওপারে চলে যায় ওদের বাবা মা।ছোট্ট টুপুরকে বুকে জড়িয়ে হয়তো খুব করে কাদে তার ভাই।পরিবারের সবাই ওদের দুই ভাই বোনকে খুব ভালবেসে বড় করতে থাকে।ভাই বোনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব।যেন একে অন্যের সম্পুরক।
টিকলু দুষ্টু হাড়ে হাড়ে।তার চাঞ্চল্য,তার বাকপটুতা সবাইকেই মুগ্ধ করে।এক বিকেলে গলির মোড়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে টিকলু আউট হয়ে গেলে সে নিজের ব্যাট থাকার কারণে আউট অস্বীকার করে।যখন বন্ধুদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল ঠিক তখন একটা ট্যাক্সি এসে থামে সেই মোড়ে।টিকলুর বয়স আর কত হবে এই চৌদ্দ কি পনের।
এর পর টিকলুর চোখ আটকে যায় সেই ট্যাক্সিতে।পিছনের সিটে বসে আছে পরীস্থান থেকে নেমে আসা কোন পরী।টিকলুর যেন চোখের পলক পড়েনা।সেই পরীর চোখ এই দৃশ্যটা এড়ায়না।ট্যাক্সি থেকে নামার পর দুবার সে নিজেও তাকায় টিকলুর দিকে।নতুন এসেছে এখানে,তাও আবার এই মাত্র ট্যাক্সি থেকে নামলো মেয়েটি।
বাবার বদলী চাকরির সুবাদে বার বার এখানে ওখানে যেতে হয় এটা তারই অংশ।মেয়েটির নাম পাপিয়া।মুখের নিচেয় একটা আচিল আছে বলে টিকলু তাকে নাম দিয়েছে আচিল।
খেলা ফেলে টিকলু বাসায় ফিরে যায়।রাতে ঘুম হয় কি হয়না কিংবা কত কি যে স্বপ্ন দেখে সে।সব স্বপ্নই রঙ্গীন।টিকলু বার বার আয়নার দিকে তাকায় চুলে চিরুনী দেয়।কাকিমা ওর ওই ধরনের হেয়ার স্টাইর পছন্দ করেন না।খোচা দিয়ে বলেন তুই কিরকম চুল আচড়াস।ওটা দেখে তো তোর বান্ধবীরা সব মনে মনে হাসে।আমি হলেতো তোর দিকে তাকাতামই না।টিকলু পাত্তা দেয়না।বলে আরে ধুর কে কি ভাবলো তাতে কি আসে যায় আর কে তাকালো না তাকালো তাতেও কিছু আসে যায়না।
জীবন চলে জীবনের নিয়মে। এর পর টিকলু আর ওর একমাত্র বোন এবং বন্ধু টুপুর একসাথে স্কুলে যায়।বাসা থেকে বের হওয়ার পর মাঝপথে টিকলু টুপুরকে থামায়।বলে টুপুর তোর কোন একটা বান্ধবীর বাসা ওই গলির ওদিকে ছিলনা?,ওইতো চায়ের দোকানের ওখানে সাদা বিল্ডিংটায়।টুপুর মনে করতে চেষ্টা করে।সে জানায় ওরাতো সেই কবেই টালিগঞ্জের দিকে চলে গেছে।এখন আর থাকেনা।
দেখা যায় টিকলু কিছুক্ষণ হাটে আবার থামে।তার পর বলে ওখানে নতুন একটা ভাড়াটিয়া এসেছে এবং একটা মেয়ে আছে তার।তাকে তার খুব ভাল লাগে।কালই প্রথম দেখা হয়েছে।মেয়েটা দুবার তাকিয়েছে।
বুকের মধ্যে কেমন করে যেন ওঠে।ছোট্ট টুপুর বুঝতে পারে তার দাদার অবস্থা।বলে আচ্ছা দাদা কিরকম করে ওঠে বুকের মধ্যে?টিকলু বলতে পারেনা।টুপুর বলে দেখলিতো দাদা কাকিমা আসার সময়ও বললো আর সেটা এখনি সত্যি।তুই একেবারে ডুবে গেছিস।তার পর দুই ভাই বোনের খুনসুটি।
সিনেমার প্রধান চরিত্র টিকলু তার দশ বছর বয়সি একমাত্র ছোট বোনের কাছে হেল্প চায়।টুপুর বলে হেল্প করতে পারি কিন্তু তুই আমাকে কি খাওয়াবি দাদা?টিকলু জানতে চায় তুই কি খেতে চাস?টুপুর ফুসকা খেতে চায়।টিকলুর কাছে মাত্র পাচটাকা ছিল সে সেটা দিয়ে ওকে ফুচকা খাওয়াতে খাওয়াতে বলে টাকাটা ঠিকই সাবাড় করলি কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু দিলিনা।দাদার দিকে তাকিয়ে টুপুর বলে শোন দাদা তোকে বুদ্ধি দিতে না পারলেও কোথায় গেলে বুদ্ধি পাবি সেটা বলে দিতে পারি।এর পর সে নোটনদার কথা বলে।টিকলুর খুশি আর ধরেনা।
নোটন দা এলাকার বড় ভাই,সব্বার ভাল বন্ধু।তার কাছ থেকে টোটকা নিয়ে নেয় এবং জেনে নেয় মেয়েটার অনেক তথ্য।মেয়েটার মা গান শেখায়।টিকলু বাসায় ফিরে টুপুরকে ধরে।বলে প্লিজ তুই আমাকে হেল্প কর।তুই প্লিজ গান শেখ।পাপিয়ার মায়ের কাছে গান শিখলে আমি তোকে নিয়ে যাবো আবার নিয়ে আসবো।সাথে পাপিয়ার সাথে দেখা হবে।টুপুরের কিন্তু ভরতনাট্যম শেখার ইচ্ছে।তার পরও পনের বছর বয়সী দাদার জন্য সে না হয় গানটাও শিখবে।কিন্তু কাকিমা সিদ্ধান্ত নিলেন টুপুরকে তিনি নিজে দিয়ে আসবেন এবং নিয়ে আসবেন।
আমরা দেখতে পাই টিকলুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে এরকম সময় সেই নোটন দা বুদ্ধি দিল।প্রথম দিনেই নিজেদের কিছু ছেলে দিয়ে টিজ করা হলো।কাকিমা ভেবেছিল টুপুরকে টিজ করছে তখন কাকা বললেন টুপুর মাত্র পিচ্চি একটা মেয়ে ওকে কেন টিজ করবে।টিজ করেছিলতো তোমাকে!টিকলুর ভাগ্য ফিরে গেল।সে রোজ এক মাত্র বোন সব থেকে ভাল বন্ধু টুপুরকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়ে গেল।পাপিয়ার সাথে তার দেখা হলো,কথা হলো এবং বন্ধুত্ব হয়ে গেল।একে অন্যকে কথা দিল কোনদিন কেউ পর হবেনা।এই সব কিছুর পিছনে টিকলুর বন্ধু সম ছোটবোনের অবদান অনেক।
সুখ চিরদিন থাকেনা।একদিন সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে টিকলু পড়ে গেল।চোখেও আঘাত লাগলে বড় ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করা হলো।বাইরে থেকে ফিরে আসার সময় দরজার বাইরে থেকে টিকলু শুনতে পেলে তার জীবনের সব থেকে কঠিন তম একটি কথা।কদিন পর আর সে দেখতে পাবেনা।এই পৃথিবীর কোন কিছু না দেখে থাকা যায় কিন্তু পাপিয়া নামের তার প্রিয় আচিলকে না দেখে সে থাকবে কি করে?আর তার একমাত্র বন্ধুসম ছোটবোন?তার চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে।ধীরে ধীরে সত্যি সত্যিই সে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে।
আচিলের কি হলো?যে আচিলকে সে একটা ছবি একে দিয়েছিল কুড়ি বছর পর আচিল দেখতে কেমন হবে সেটা কল্পনা করে।বাবার বদলীর সুবাদে আচিল আবার চলে গেল।টিকলুর আর কিছুই বাকি থাকলো না।ও যখন নিরবে বিছানায় বসে আকাশ পাতাল ভাবছে তখন টুপুর এসে ওর হাতে একটা ক্যাসেট ফিতা ধরিয়ে দিয়ে বললো পাপিয়া দি এটা তোমাকে দিয়েছে।
ঘটনার মোড় নিতে নিতে টিকলু সাথে সাথে সেটা ক্যাসেট প্লেয়ারে চালিয়ে দিতেই পাপিয়ার কন্ঠ ভেসে আসলো্।কোন একজন বিখ্যাত মানুষ বলেছেন আমরা কিন্তু চোখ দিয়ে দেখিনা আমরা দেখি মনের অভ্যন্তর দিয়ে।টিকলু তুমি একটু চেষ্টা করলেই আমাকে দেখতে পাবে।আমি হারিয়ে যাবোনা।আমি তোমারই থাকবো।তুমি নিজে বলেছিলে লোড শেডিং বেশিক্ষণ থাকেনা।দেখো টিকলু আলো আসবেই।
সেই রেকর্ড বার বার শোনে সে।বিশ বছর কেটে যায়।টিকলুর চোখে অপারেশান হয়।যেদিন ব্যান্ডেজ খোলা হবে সে চায় সেদিন প্রিয়জনেরা উপস্থিত থাক।সে জানে সবাই থাকলেও থাকবেনা পাপিয়া।বিশ বছর আগে চোখের্ আলোর সাথে সাথে সেও হারিয়ে গেছে।ব্যান্ডেজ খোলার দিন টুপুর এসে দাদার পাশে বসে বলে দাদা দেখ কারা তোকে দেখতে এসেছে।টিকলু অন্ধদের পড়াতো।তারা সবাই এসেছে ওর পাশে দাড়াতে।যদিও টিকলুর চোখে তখনো ব্যান্ডেজ।
টিকলুর চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়।তার একমাত্র বন্ধু একমাত্র ছোটবোন টুপুর তখন ওর চোখের সামনে মেলে ধরে বিশ বছর আগে আকা ওরই সেই ছবিটা যে ছবিতে সে বিশ বছর পরের পাপিয়াকে কল্পনা করেছিল।ছবি দেখে তার চোখ বেয়ে যখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সে তখন ছবিটা নিচে নামা।ছবির পিছনে অ্যাপ্রন পরা পাপিয়া চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে।এই জল আনন্দের।টিকলুর চিনতে ভুল হয়না যে এই তার আচিল এই তার পাপিয়া।ফিরে পাওয়ার আনন্দে সেদিন পুরো কেবিন ভেসে যায়।
টিকলু আর টুপুর এই দুই ভাই বোনের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা দেখে আমি মুগ্ধ।বোন হিসেবে ভাইয়ে প্রেম করিয়ে দিয়েছে বলেই নয় বরং ছোট বোন হয়েও ভাইকে সব ধরনের সমস্যা থেকে আগলে রাখার যে দৃষ্টান্ত আমি টুপুরের মধ্যে দেখেছি তাতে মুগ্ধ।আমি বিশ্বাস করি যে কারো যদি টুপুরের মত একটা বোন থাকে তবে তার চেয়ে সুখী ভাই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর থাকার কথা নয়।
টিকলু আর টুপুর দুই ভাই বোন সিনেমার চরিত্র।কিন্তু আমার জীবনে সত্যিকার টিকলু আর টুপুর আমি দেখেছি।নাহ সেই টিকলু কখনো বন্ধুত্ব ভালবাসার জন্য বোনের কাছে হেল্প চায়নি কিন্তু পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি বিষয়ে বোন তার ভাইকে হেল্প করেছে,আগলে রেখেছে,উৎসাহ দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে।সিনেমার টিকলু আর টুপুর বাস্তবে আমাদের ঘরেই বাস করছে।
সৌকর্য ঘোষালের সিনেমা “লোডশেডিং” এর গল্প বলছিলাম।ওপার বাংলার এই সিনেমাটি আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে।অন্যদের বিষয়টা জানিনা আমার কাছে বেশি ভাললেগেছে ছোট্ট দুইটা ভাই বোনের অসাধারণ চরিত্র দুটিকে।
পুরো সিনেমাটি দেখলে আশা করি সবারই খুবই ভাল লাগবে।আমি ঠিক সেভাবে রিভিউ না লিখে পুরো গল্পটাকেই কিছুটা ছোট করে শেয়ার করলাম।বাকিটা সিনেমা দেখে অনুভব করে নিন।
সিনেমাঃ লোডশেডিং
পরিচালক” সৌকর্য ঘোষাল
রিভিউঃ জাজাফী
৫ ডিসেম্বর ২০১৬
Comments are closed.