মা বা বাবার কোল — শিশুর কাছে এটি শুধু আরাম নয়, এটি তার পৃথিবী। অনেক অভিভাবক চিন্তায় পড়েন, যখন দেখেন তাদের শিশুটি কোল ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। খাটে শোয়ালে কান্না শুরু হয়, কিন্তু কোলে নিলেই শান্ত। এমন আচরণে অনেকেই ভাবেন, “শিশুটি কি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে?”
আসলে বিষয়টি একেবারেই স্বাভাবিক — এবং এর পেছনে রয়েছে মানসিক ও জৈবিক উভয় কারণ।
👶 ১. মায়ের গন্ধ ও হৃদস্পন্দন শিশুর নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়
জন্মের পর প্রথম কয়েক মাসে শিশুর জগৎ খুব ছোট — সে কেবল মায়ের গন্ধ, কণ্ঠস্বর ও হৃদস্পন্দন চেনে। গর্ভের ভিতরে সে নয় মাস ধরে এই শব্দ ও গন্ধেই অভ্যস্ত ছিল। তাই জন্মের পর মায়ের কোলে থাকলেই তার মনে হয় সে এখনও সেই নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। কোলে থাকলে সে স্বস্তি, উষ্ণতা ও নিরাপত্তা অনুভব করে।
❤️ ২. ভালোবাসা ও অক্সিটোসিন হরমোনের সম্পর্ক
যখন মা তার শিশুকে কোলে নেন, তখন শরীরে অক্সিটোসিন নামে এক ধরনের “ভালোবাসার হরমোন” নিঃসৃত হয়। এটি মা ও শিশুর মধ্যে এক গভীর বন্ধন তৈরি করে। শিশুটি যখন কাঁদে, তখন কোলে নেওয়া ও মায়ের কণ্ঠে কথা বললে এই হরমোনের প্রভাবে সে দ্রুত শান্ত হয়ে যায়।
🌙 ৩. ‘ভেলক্রো বেবি’ আচরণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক
যে শিশু সবসময় মা বা বাবার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়, তাকে অনেক সময় “ভেলক্রো বেবি” বলা হয়। ‘ভেলক্রো’ মানে যেমন দুটি জিনিস শক্তভাবে লেগে থাকা — তেমনি এই শিশুরা মায়ের কোলে লেগে থাকতে ভালোবাসে। এটি কোনো খারাপ অভ্যাস নয়, বরং তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের অংশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যখন তারা পৃথিবীটাকে একটু ভালোভাবে চিনে নেয়, তখন নিজের মতো খেলা করা বা একা থাকা শিখে যায়।

🌤️ ৪. কোলে থাকলে শিশুর ঘুম ও পরিপাক ভালো হয়
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুকে কোলে রাখলে তার হার্টবিট স্থিতিশীল থাকে, দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং পরিপাকক্রিয়া উন্নত হয়। এমনকি ‘skin-to-skin contact’ বা ত্বকের স্পর্শ শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়াতে পারে। তাই কোলে নেওয়া কেবল আবেগের বিষয় নয়, এটি শিশুর শারীরিক বিকাশেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
🧸 ৫. কখন উদ্বিগ্ন হওয়া প্রয়োজন?
যদি শিশুটি একদমই কোলে ছাড়া না থাকে, সবসময় অস্থির থাকে, ঘুমাতে না চায় বা ওজন না বাড়ে — তবে এটি শুধু “কোলপ্রিয়তা” নয়, অন্য কোনো শারীরিক অস্বস্তির ইঙ্গিতও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।

🌼 ৬. অভিভাবকদের জন্য কয়েকটি টিপস
- শিশুকে কোলে নেওয়া কোনো ভুল নয় — এটি তার প্রয়োজন।
- ধীরে ধীরে শিশুকে নিজের আশেপাশের পরিবেশে অভ্যস্ত হতে দিন।
- মায়ের গন্ধযুক্ত কাপড় বা কম্বল শিশুর পাশে রাখলে সে নিরাপদ বোধ করে।
- বাবা-মা দুজনেই কোলে নেওয়া, গান গাওয়া বা কথা বলায় অংশ নিন — এতে শিশুটি উভয়ের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে।
🌙 শেষ কথা
আপনার শিশুটি কোলে থাকতে চায়, কারণ সে আপনাকে ভালোবাসে এবং আপনার উপস্থিতিতে নিরাপদ বোধ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যখন তার আত্মবিশ্বাস ও পৃথিবী সম্পর্কে বোঝাপড়া বাড়বে, তখন সে নিজে থেকেই ধীরে ধীরে কোলে থাকার সময় কমিয়ে দেবে।
তাই শিশুকে কোলে নেওয়া মানে তাকে “বিগড়ে ফেলা” নয়, বরং তাকে ভালোবাসা ও নিরাপত্তার ভিত্তি দেওয়া — যা তার মানসিক বিকাশের প্রথম পাঠ।







