একজন শিশুর শিক্ষা শুরু হয় তার মা-বাবার কাছ থেকে। এরপরই আসে স্কুলের নাম। পরিবারের পর একটি স্কুল শিশুর জীবনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। তাই শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্কুলের অবদান অনেক, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্কুলের নিয়মকানুন, স্কুলের সংস্কৃতি—সবকিছুই ছাত্রছাত্রীদের প্রভাবিত করে। যেমন স্কুলের রুটিন শিশুকে শেখায় সময়ানুবর্তিতা। স্কুলের বিভিন্ন খেলাধুলা দলগত কাজ করার মানসিকতা গড়ে তোলে। একটি স্কুল যদি মৌলিক, মানবিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়, তাহলে শিশুরা সহজেই তা তাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারে। ভালো ব্যবহার করা, বড়দের শ্রদ্ধা করা, ছোটদের সাহায্য করা, অন্যদের সহযোগিতা করা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা—এই সবকিছুর শিক্ষা পরিবারের পাশাপাশি স্কুলে চর্চা করতে হবে। স্কুলও অভিভাবক। এখান থেকে ভালো যা কিছু শিখবে, ছাত্রছাত্রীরা তা জীবনে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবে।
আমাদের স্কুলে আমরা প্রথম থেকেই ‘হেলথ অ্যান্ড মরাল’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম এ কারণে। দুই বছর যাবৎ আমরা কিছু সময়গত প্রতিকূলতার জন্য বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে রাখতে পারছি না, তবে অচিরেই তা আবার চালু করার ইচ্ছা আছে। এই মুহূর্তে প্রতি ১৫ দিন পরপর ক্লাসগুলোতে নীতি-নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়, যা শিশুদের নতুন করে ভাবায় চারপাশ নিয়ে। আমি মনে করি, একটি শিশুকে জীবনের কঠিন দিকগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে পরিচয় করানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত। প্রথা হিসেবে আমরা প্রতি রোববার অ্যাসেম্বলিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক খবর বলতে বলি। এতে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে আমরা দেশকে নতুন করে চিনছি। এটা শুধু ছাত্রছাত্রীদের দেশের প্রতি ভালোবাসা ও গর্ববোধ করাই শেখাচ্ছে না, পাশাপাশি এত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে ইতিবাচক কিছু করা যায়, তা শেখাতে পারছে। আমার মতে, এই শিক্ষা অনেক বেশি জরুরি।
আজকের যুগে আমাদের পাশাপাশি শিশুরাও অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। মুঠোফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ কম্পিউটার ইত্যাদি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। এই বিষয়গুলোর উপকারিতা যে নেই তা নয়, তবে এগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাবও যে খুব উপকারী, তা বলা যাচ্ছে না। প্রতিদিন এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই মা-বাবা জানতেও পারছেন না যে তাঁর সন্তান হয়তো সাইবার বুলিংয়ে আক্রান্ত হচ্ছে অথবা নিজেই বুলি করছে। আমার জানামতে, অনেক ছাত্রছাত্রী তাদের গাড়ির চালক বা বাসার কেয়ারটেকারের ফোন ব্যবহার করে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। আমি মনে করি এটি খুব বিপজ্জনক। বিভিন্ন®ছবি, কথা এর মাধ্যমে অচেনা লোকের হাতে চলে যাচ্ছে সহজেই। ইদানীং সাইবার বুলিংয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। এসব ব্যাপারে পরিবারের সঙ্গে স্কুলগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্কুলগুলোতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও ওয়াকিবহাল করাটা জরুরি। আমরা আমাদের স্কুলে শিগগিরই এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।
একজন শিশুকে ®জীবনমুখী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি অন্যের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব ও সহমর্মিতা শেখানোর ব্যাপারে জোর দিতে হবে। বিভিন্ন দাতব্য সেবামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন শিশুকে তার আশপাশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কথা ভাবতে শেখায়। আমাদের স্কুলে এমন একটি উদ্যোগ হলো ‘স্পেলেথন’, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিটি সঠিক বানান লেখার মাধ্যমে একটি অনুষ্ঠান করে, যা সম্মিলিত করে আমরা ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন তরী’তে দান করি। যেখানে এই টাকা দিয়ে বহু সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা করা হয়। গত বছর এ রকম অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান সাহায্য করেছে। আমি মনে করি, এই কাজগুলো শিশুদের সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করছে। অন্যের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দটাও উপলব্ধি করাটা খুব জরুরি আমার মতে। স্কুলগুলোতে আমাদের আরও অনেক সুযোগ আছে এ ব্যাপারে কাজ করার। আশা করি অভিভাবকেরাও এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করবেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনে চলার পথে বাকি যে শিক্ষাগুলো অপরিহার্য, তা অন্তর্ভুক্ত করে যদি এগোনো যায়, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা।
* সাবরিনা শহীদ
অধ্যক্ষ, স্যার জন উইলসন স্কুল, ঢাকা
Comments are closed.